রচনা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
রচনা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

স্বদেশপ্রেম বাংলা রচনা






ভূমিকা: নিজ দেশ ও জন্মভূমির প্রতি মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসাই স্বদেশপ্রেম। স্বদেশের প্রকৃতি ও ধূলিকণা আমাদের নিকট অতি প্রিয় ও পবিত্র। শিশুকাল থেকেই মানুষ স্বদেশের মাটিতে বেড়ে ওঠে। মায়ের বুক যেমন সন্তানের নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত আশ্রয়, স্বদেশের কোলে মানুষ তেমনি নিরাপদ ও নিশ্চিত আশ্রয় লাভ করে। স্বদেশকে ভালোবাসার মাঝেই মানব জীবনের চরম সার্থকতা নিহিত। তাই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন-

“সার্থক জন্ম আমার জন্মেছি এই দেশে।সার্থক জনম মাগো তোমায় ভালোবেসে।”

স্বদেশপ্রেম কী: স্বদেশপ্রেম মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ ও সহজাত প্রবৃত্তি। মানুষ যে দেশে জন্মগ্রহণ করে সেটিই তার জন্মভূমি। জন্মভূমির প্রতি, স্বজাতির প্রতি, মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা ও গভীর শ্রদ্ধাবোধই স্বদেশপ্রেম। দেশপ্রেমীর নিজ দেশের প্রতি রয়েছে অকৃত্রিম ভালোবাসা, সীমাহীন আনুগত্য। বিশ্বের উন্নত জাতিগুলো স্বদেশের জন্য আত্মত্যাগ করেই উন্নতির স্বর্ণশিখরে আরোহণ করেছে। স্বদেশপ্রেম না থাকলে দেশ ও জাতির উন্নতি আশা করা যায় না। স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সুখী দেশ গড়তে হলে তাই নাগরিকদের অবশ্যই স্বদেশপ্রেমী হতে হবে।

স্বদেশপ্রেমের উৎস: প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের দেশকে ভালোবাসে। সকল জীবের মধ্যেই এ গুণ বিদ্যমান। বন্যপশুকে বনভূমি ছেড়ে লোকালয়ে আনলে, পাখিকে নীড়চ্যুত করলে তারা আর্তনাদ শুরু করে। এটি করে নিজ আবাসস্থানের প্রতি ভালোবাসার টানে। নিজ আবাসের প্রতি ভালোবাসা থেকে জন্ম নেয় স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা। স্বদেশের মাটি, পানি, আলো, বাতাস যেন আমাদের জীবনেরই অঙ্গ। এগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া অঙ্গহানির শামিল। এগুলোর প্রতি মমত্ববোধ থেকেই সৃষ্টি হয় স্বদেশপ্রেম। দেশের মাটির প্রতি মমত্ববোধের সাথে মিশে থাকে শ্রদ্ধা, প্রীতি ও গৌরববোধের আকাঙ্ক্ষা।

স্বদেশপ্রেমের স্বরূপ : মানুষ সমগ্র বিশ্বের বাসিন্দা হলেও একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ডে সে বেড়ে উঠে। একটি বিশেষ দেশের অধিবাসী হিসেবে সে পরিচয় লাভ করে। এ দেশই তার জন্মভূমি, তার স্বদেশ। মানুষ স্বদেশে জন্মগ্রহণ করে ও স্বদেশের ভালোবাসায় লালিত-পালিত হয়। নিজেকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার সকল উপাদান সে স্বদেশ থেকে পায়। ফলে স্বদেশের প্রতি প্রবল মমত্ববোধ সৃষ্টি হয়। এ জন্য মানুষ স্বদেশের গৌরবে গৌরবান্বিত হয় এবং স্বদেশের অপমানে অপমাণিত হয়। স্বদেশের স্বাধীনতা ও মান-মর্যাদা রক্ষার জন্য নিজের প্রাণ উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকে। কবি ঈশ্বচন্দ্র গুপ্ত তাই লিখেছেন-

“মিছা মনিমুক্তা হেম স্বদেশের প্রিয় প্রেমতার চেয়ে রত্ন নাই আর।”

স্বদেশপ্রেমের প্রকাশ: স্বদেশপ্রেম মানব হৃদয়ে লালিত হয়। আর স্বদেশপ্রেম প্রকাশ পায় জাতীয় জীবনের দুঃসময়ে মানুষের কর্মের মাধ্যমে। স্বদেশের স্বাধীনতা রক্ষায়, স্বদেশের মানুষের কল্যাণ সাধনে মানুষের মনে স্বদেশপ্রেম জেগে ওঠে। যাঁরা দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন, দেশের জন্য সংগ্রাম করেছেন তাদের নাম ও কীর্তি চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁদের সে প্রেম ও আত্মত্যাগ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবে চিরকাল। স্বদেশের তরে জীবন উৎসর্গকারীরা সমগ্র বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলতে হয়-

ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা।তোমাতে বিশ্বময়ীর তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।

দেশপ্রেমের ভিন্নতর বহিঃপ্রকাশ: কেবল দেশকে ভালোবাসার মধ্যে দেশপ্রেম সীমাবদ্ধ নয়। দেশকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে নেওয়া যেমন শিল্প সাহিত্য, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজনীতি প্রভৃতির ক্ষেত্রে অবদান রাখাও দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ। সম্প্রতি ২৬ মার্চ জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলা গাইতে ২ লক্ষ ৫৪ হাজার ৬৮১ জন মানুষের একত্রিত হওয়া দেশপ্রেমরই বহিঃপ্রকাশ। দেশের কল্যাণ ও অগ্রগতিতে ভূমিকা রেখে বিশ্বসভ্যতায় গৌরব বাড়ানো যায়। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ড. মুহাম্মদ ইউনুস, সাকিব আল হাসান প্রমুখের গৌরবময় অবদানের জন্য বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। দেশপ্রেমের উজ্জ্বল বহিঃপ্রকাশ আমরা নবী করীম (স.) এর মধ্যে দেখতে পাই, দেশকে ভালোবেসে তিনি বলেছিলেন- “হে মাতৃভূমি তোমার লোকেরা যদি আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র না করত তবে আমি কখনই তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।”

স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেম: স্বদেশকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে বিশ্বকে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। স্বদেশপ্রেম কখনও বিশ্বপ্রেমের বাধা হয় না। দেশপ্রেম যদি বিশ্ববন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের সহায়ক না হয় তবে তা প্রকৃত দেশপ্রেম হতে পারে না। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলকেই দেশপ্রেমের চেতনায় উৎসাহিত হতে হবে। যে নিজের দেশকে ভালোবাসে না সে অন্য দেশ, ভাষা, গোষ্ঠী তথা মানুষকে ভালোবাসতে পারবে না। তাই দেশপ্রেমের মধ্যেই বিশ্বপ্রেমের প্রকাশ ঘটে।

সাহিত্যের আয়নায় দেশপ্রেম: বিভিন্ন কবি সাহিত্যিক তাদের কবিতা, কাব্য, নাটক, গান, উপন্যাস প্রভৃতি লেখনির মাধ্যমে তাদের দেশপ্রেমকে ফুটিয়ে তুলেছেন। আধুনিক যুগে বাংলা সাহিত্যে দেশপ্রেমের বিকাশ ঘটে ব্রিটিশ আমল থেকেই। নীলদর্পণ, আনন্দমঠ, মেঘনাদ বধ প্রভৃতি গ্রন্থে দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটেছে। এছাড়া নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখের সাহিত্যে দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটেছে।

ছাত্রজীবনে স্বদেশ প্রেমের শিক্ষা: স্বদেশপ্রেম মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হলেও এ গুণটি তাকে অর্জন করতে হয়। তাই ছাত্রজীবন থেকেই দেশপ্রেমের দীক্ষা গ্রহণ করতে হয়। দেশের মাটি ও মানুষকে ভালোবাসতে হবে। ছাত্রজীবনে যে দেশপ্রেম মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় তা মনে আজন্ম লালিত হয়। আজকের ছাত্ররাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। ভবিষ্যতে দেশের ভালো-মন্দ তাদের উপর অর্পিত হবে। সবার আগে দেশের বিপদে-আপদে ও প্রয়োজনে ছাত্রদেরকেই এগিয়ে আসেত হবে। প্রয়োজনে দেশের স্বার্থে ছাত্রদেরকে জীবন উৎসর্গ করতে হবে। যেমনটি ছাত্ররা করেছিল ১৯৫২ সালের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে অকাতরে প্রাণ উৎসর্গ করে।

স্বদেশপ্রেমের প্রভাব: স্বদেশেপ্রেমের মহৎ চেতনায় মানব চরিত্রের সৎ গুণাবলি বিকশিত হয়। মানুষের মন থেকে সংকীর্ণতা ও স্বার্থপরতা দূর হয়। স্বদেশপ্রেম মানুষকে উদার ও মহৎ করে, পরার্থে জীবন উৎসর্গ করতে প্রেরণা দেয়। স্বদেশপ্রেমের কারণেই মানুষ আত্মসুখ ত্যাগ করে দেশ ও জাতির কল্যাণ করে, দেশবাসীকে ভালোবাসো।

স্বদেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত: যুগে যুগে অসংখ্য মনীষী স্বদেশের কল্যাণে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। এ উপমহাদেশে মহাত্মা গান্ধী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং নাম না জানা লক্ষ লক্ষ শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা দেশের জন্য জীবন দিয়ে অমর হয়েছেন। বিশ্ব অঙ্গনে দেশপ্রেমের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত রেখেছেন চীনের মাওসেতুং, রাশিয়ার লেলিন ও স্ট্যালিন, আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন প্রমুখ ব্যক্তি। দেশেপ্রেমের জন্যেই তাদের সকলের নাম বিশ্বের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতি ও দেশপ্রেম: নগর কেন্দ্রীক সভ্যতায় মানুষ তার পাশের বাড়ির মানুষের কথাই ভুলে গেছে। মানুষ আজ নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। দেশের মানুষের চিন্তা করার মানসিকতা তার নেই। মানুষের মধ্যে বাঁচার তাগিদ আজ আর কেউ অনুভব করে না। কেননা মানুষের মধ্যে বাঁচা মানে দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য বাঁচা। কিন্তু সবাই এখন নিজের জন্য বাঁচতে চায়। তাই দেশ ও জাতির জন্য আমাদের এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

উগ্র দেশপ্রেম: দেশপ্রেম দেশ ও জাতির জন্য গৌরবের। কিন্তু উগ্র দেশপ্রেম ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দুটি বিশ্বযুদ্ধ উগ্র জাতীয়তাবাদ তথা উগ্র দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ। জার্মানির হিটলার ও ইতালির মুসোলিনির উগ্র জাতীয়তা ও দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। তাই উগ্র দেশপ্রেম সব সময় অশুভ, চির অকল্যাণকর ও চির অশান্তির।

উপসংহার: জন্মভূমি সকলেরই প্রিয়, তা রক্ষার দায়িত্বও সকলের। তবে মনে রাখতে হবে নিজের দেশকে রক্ষার নামে অপরকে আক্রমণ করা মানবতাবিরোধী। স্বদেশপ্রেমের মতো পবিত্র গুণ আর নেই। তাই জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের উচিত স্বদেশকে ভালোবাসা। প্রকৃত দেশপ্রেমী মানুষ সকলের কাছে পরম পূজনীয়। দেশ ও জাতির কল্যাণে আত্মত্যাগকারী ব্যক্তিই বিশ্ববরেণ্য।





মঙ্গলবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৯

বৃক্ষরোপণ ও বৃক্ষসম্পদ উন্নয়ন বাংলা রচনা





ভূমিকা: প্রকৃতি সব সময়ই ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তার সে পরিবেশকে রক্ষা করে থাকে। এ ক্ষেত্রে তাকে সহায়তা করে বৃক্ষরাজি অর্থাৎ তার বিস্তৃত বনাঞ্চল। কিন্তু সভ্যতাকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে এবং নিজেকে সভ্য করে তুলতে মানুষ অবাধে আঘাত হেনেছে প্রকৃতির রক্ষাকবচ এই বৃক্ষের ওপরে। ফলে প্রকৃতির প্রতিক্রিয়া দেখতেও আমরা বাধ্য হয়েছি এবং হচ্ছি। একের পর এক আমাদের প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হতে হচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় যেখানে কোনো দেশের মোট আয়তনের অন্তত ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন সেখানে বেশিরভাগ দেশই তা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। এর ফলে বৃক্ষহীনতায় পৃথিবীর অনেক অঞ্চলে মরুভূমির সৃষ্টি হচ্ছে।

বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা: বৃক্ষের সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের অস্তিত্বের সম্পর্ক। আমাদের জীবন ও জীবিকার জন্য বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। বৃক্ষ সমস্ত প্রাণীর খাদ্য যোগান দেয়। বিশাল এ প্রাণীজগৎকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অক্সিজেন দেয়। সেই সাথে প্রাণীজগৎকে বিপন্নকারী কার্বন-ডাই অক্সাইড শোষণ করে। তার সুবিশাল শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে বৃক্ষ দগ্ধ পৃথিবীকে শীতল করে। বন্যা, ক্ষরা, ঝড় নিয়ন্ত্রণ করে বৃক্ষ প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে। আবহাওয়া ও জলবায়ুকে নাতিশীতোষ্ণ রাখে। মাটিকে উর্বর করে তোলে। গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়া রোধ করে পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তোলে বৃক্ষ। আমাদের জীবনযাপনের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী যেমন- আসবাবপত্র, জ্বালানি, কাঠ, গৃহনির্মাণ, রেল লাইনের স্লিপার, নৌকা, লঞ্চ, বাঁধ ইত্যাদি নির্মাণে যে বিপুল পরিমাণ কাঠ প্রয়োজন হয় তা আসে এই বৃক্ষ থেকে। বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল যেমন রেয়ন, পেন্সিল, কাগজের মন্ড, দেশলাইয়ের কাঠি ও বাক্স, কর্পূর, রাবার ইত্যাদি আমরা বৃক্ষ থেকে পাই। জীবন রক্ষাকারী ভেষজ বিভিন্ন ওষুধের মূল্যবান উপাদানও বৃক্ষই সরবরাহ করে।



বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি: জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের উন্নত ও সুসভ্য দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশের চেয়ে বেশিমাত্রায় বনভূমি ধ্বংস করছে। কিন্তু এর ক্ষতিকর প্রভাব বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পড়ছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ওপরে। উন্নত দেশগুলোর অধিক হারে বৃক্ষনিধনের ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাচ্ছে। ফলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বায়ুম-লের ওজনস্তরে ফাটল ধরেছে। যার ফলে গ্রিন হাউজ ইফেক্টের মতো মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থার প্রতিকার এখনই করা না হলে আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে সারাবিশ্বে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ দ্বিগুন হয়ে যাবে এবং জীবনযাত্রা চরম ঝুঁকিপূর্ণ হবে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন।

বৃক্ষরোপণ কেন প্রয়োজন: সভ্যতাকে আরও এগিয়ে নিতে এবং শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারের লক্ষ্যে প্রতিনিয়তই আমরা বনাঞ্চল ধ্বংস করছি। আর এর সবই করছি বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে। নিজেদেরকে উন্নত দেশগুলোর কাতারে নেয়ার চেষ্টায় উন্নয়নশীল দেশগুলো অবিরাম ছুটে চলেছে। অন্যদিকে উন্নত দেশগুলো চেষ্টা করছে নিজেদেরকে আরও উন্নত করতে। আর এসব করতে গিয়ে সমস্ত চাপ এসে পড়ছে প্রকৃতির উপর। বিশেষ করে বনভূমির ওপর। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে নিত্যনতুন সমস্যা। আর এই সকল সমস্যা প্রতিরোধের জন্য আমাদেরকে বনায়নের জন্য কাজ করতে হবে। যে সমস্ত সমস্যা মোকাবেলায় আমাদেরকে বৃক্ষরোপণ করতে হবে তা হলো-

১। প্রাকৃতিক দুর্যোগ রোধ: ২০০৭ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী আমেরিকান রাজনীতিবিদ ‘আল গোর’ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ হিসেবে বৈশ্বিক উষ্ণতাকে দায়ী করেন এবং এর পেছনের কারণ হিসেবে তিনি অধিক জনসংখ্যা এবং তাদের চাহিদাপূরণের লক্ষ্যে নির্বিচারে বৃক্ষনিধন এর কথা বলেন। বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণেই আমরা স্বল্প বিরতিতে বিভিন্ন ঝড়, ক্ষরা, নদী ভাঙন, বন্যার সম্মুখীন হচ্ছি। আমাদের দেশে উপকূলীয় দুর্যোগ রক্ষা করে উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধের জন্য আমাদেরকে বৃক্ষরোপণ করতে হবে।



২। বায়ুদূষণ রোধ: বৃক্ষ পরিবেশ থেকে ক্ষতিকর কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে অক্সিজেন সরবরাহ করে। কিন্তু অধিক হারে বৃক্ষনিধনের ফলে দিন দিন বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃক্ষহীনতার ফলে বায়ু দূষণের জন্য দায়ী অন্যান্য যে সকল উৎসগুলো আছে সেগুলোকেও পরিবেশ নিজ ক্ষমতায় পরিশোধন করতে পারছে না। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে বায়ু দূষণ এবং এই কারণে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে প্রাণঘাতী বিভিন্ন রোগে। তাই এই বায়ুদূষণ এবং তার থেকে সৃষ্ট রোগবালাই থেকে মুক্ত থাকতে আমাদেরকে পর্যাপ্ত পরিমাণ বনায়ন করতে হবে।

৩। গ্রিন হাউজ ইফেক্ট প্রতিরোধ: বিজ্ঞানীদের মতে এই গ্রিন হাউজ ইফেক্টের ফলে নিকট ভবিষ্যতে আর্কটিক মহাসাগরের বিশাল বরফ স্তর গলে সমুদ্রের পানির স্তর বেড়ে যাবে। আর তা যদি ১ মিটারও বাড়ে তাহলে পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ, বিশেষ করে মালদ্বীপ ও বাংলাদেশের মতো দেশগুলো ১০ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যাবে। আর তাই এর থেকে নিস্তার পেতে হলে আমাদেরকে অধিক হারে বনায়ন করতে হবে।

৪। ভূমি ক্ষয়রোধ: বনভূমি ধ্বংসের ফলে ভূমিক্ষয় বৃদ্ধি পায় এবং ক্ষরা ও মরুকরণ দেখা দেয়। তাই ভূমিক্ষয় রোধের জন্য বৃক্ষরোপণ করা খুবই প্রয়োজন।

বৃক্ষরোপণ অভিযান: রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- ‘দাও ফিরিয়ে সেই অরণ্য, লও এ নগর’। অর্থাৎ তার সময়েই তিনি বনভূমির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। অনেক সময় পেরিয়ে গেছে, তবে বর্তমানে আমাদের সরকারগুলোও বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে। আর তা সবাইকে অনুধাবন করাতে সরকার বৃক্ষরোপণকে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিয়েছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে দেশকে বাঁচাতে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহকে বেছে নেয়া হয়েছে বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ হিসেবে। মৌসুমী বৃষ্টিপাত হওয়ায় এই সময়কে বৃক্ষরোপণের জন্য উপযুক্ত সময় হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকার নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন নার্সারি থেকে লক্ষ লক্ষ চারা গাছ জনগণের মধ্যে বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে বিতরণ করছে। পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও সংস্থাও এই অভিযানে এগিয়ে এসেছে। সরকার সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও ভূমিক্ষয় রোধে উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী গড়ে তুলতে উপকূলবাসীকে সম্পৃক্ত করার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে।

বনভূমি উন্নয়নে সরকারি উদ্যোগ: বনজ সম্পদ উন্নয়ন ও তার সুষ্ঠু ব্যবহারের জন্য সরকার বাংলাদেশ বন শিল্প উন্নয়ন সংস্থা গড়ে তুলেছে। গঠন করেছে বন গবেষণা প্রতিষ্ঠান। সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে বেসরকারিভাবে কাঠ ও অন্যান্য দ্রব্য আহরণ নিষিদ্ধ করেছে। বনভূমি সম্প্রসারণের জন্য বনের আশেপাশের জমি সরকারি দখলে নেয়া হয়েছে এবং সেখানে বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে। সরকারের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে সারাদেশে ৫২,০০০ একর জমিতে এবং সমুদ্র উপকূলে ৪০,০০০ একর জমিতে বনভূমি সৃষ্টি করা হয়েছে। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে ১৩,০০০ একর জমিতে নতুন বনভূমি সৃষ্টি করা হয়েছে আর প্রায় ১৫,০০০ একর জমিতে নতুন বনভূমি সৃষ্টি করার জন্য ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

বনভূমি উন্নয়নে করণীয়: দেশের অর্থনৈতিক ও অন্যান্য চাহিদা পূরণের জন্য বনভূমি ও বনজ সম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু আমাদের দেশে প্রয়োজনের তুলনায় বনভূমির পরিমাণ অত্যন্ত কম। অবাধে বৃক্ষ নিধনের ফলে আমাদের বনভূমি সংকুচিত হয়ে এসেছে। কিন্তু আমাদের অর্থনৈতিক ও অন্যান্য প্রয়োজনে এই বনভূমি ও বনজসম্পদের সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন। আর এ জন্য যা করণীয়-
* নতুন বনভূমি গড়ে তুলতে হবে। নদীর তীরবর্তী অঞ্চল, উপত্যকা, পাহাড়ি উচ্চ এলাকা ও সমুদ্র উপকূলে পর্যাপ্ত বনায়ন করতে হবে।

* নির্বিচারে বৃক্ষনিধন রোধ করতে হবে। মূল্যবান বৃক্ষসমূহ সরকারি অনুমতি ছাড়া নিধন করা নিষিদ্ধ করতে হবে।
* সরকারি তত্ত্বাবধানে বনাঞ্চল সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণ করতে হবে। বনজ সম্পদ রক্ষায় ও এর উন্নয়নের জন্য বনবিভাগের কর্মকর্তাদের যথেষ্ট প্রশিক্ষণ দিতে হবে। বনবিভাগীয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দুর্নীতি দমন করতে হবে।
* বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে অভয়ারণ্য গঠন ও সংরক্ষণ করতে হবে। জনগণকে সচেতন হতে হবে। বিনামূল্যে জনগণের মাঝে চারাগাছ বিতরণ করতে হবে।
* বনভূমি থেকে কাঠ সংগ্রহের জন্য যেন আর কোনো গাছ কাটা না হয় সে ব্যবস্থা নিতে হবে। কাটা হলেও সেখানে নতুন গাছ লাগিয়ে যেন সেই শূন্যতা পূরণ করা হয়। জ্বালানি হিসেবে কাঠের বিকল্প খুঁজতে হবে।
* বৃক্ষরোপণ অভিযানকে শুধুমাত্র একটি সপ্তাহে সীমাবদ্ধ না রেখে বছরের অন্যান্য সময়ে তা চালিয়ে যেতে হবে।
* চোরাইপথে বৃক্ষনিধন প্রতিরোধ করতে হবে। এজন্য সরকার এবং জনগণকে সচেষ্ট হতে হবে।

উপসংহার: বৃক্ষহীন একটি পৃথিবীতে আমরা কখনই বেঁচে থাকতে পারব না। আমাদের নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যই বনায়নের ওপর অর্থাৎ বৃক্ষরোপণের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ব্যক্তিগত পারিবারিক উন্নয়ন এবং জীবন ও জীবিকার তাগিদে আমাদেরকে বনভূমির সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করতে হবে। শুধুমাত্র সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়েই নয় বরং ব্যক্তিগতভাবেও যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে এবং সেই উদ্যোগের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।


মঙ্গলবার, ৬ আগস্ট, ২০১৯

কন্যাশ্রী প্রকল্প বাংলা রচনা



ভূমিকা :– প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে কন্যা সন্তানের প্রতি অবহেলা ভারতীয় সংস্কৃতিতে বোদ্ধ মূল হয়ে রয়েছে । বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে বর্তমান কালে সেই অবহেলার স্বরূপ অনেকটা স্থিমিত হলেও দরিদ্র মানুষদের মধ্যে আর্থ – সামাজিক কারণে আর তা হয়নি বলেই পশ্চিমবঙ্গ সরকার কন্যাশ্রী প্রকল্পের মাধ্যমে রাজ্যর কন্যা সন্তানের প্রতি গুরুত্ব আরপ করতে এবং বাল্যবিবাহ বন্ধ করে কন্যা সন্তানদের বিদ্যালয়মুখী করতে " কন্যাশ্রী " প্রকল্পের যে অবতারনা করেছেন তা যথেষ্ট প্রসংশিত হয়েছে ।

প্রেক্ষাপট :– কবি কালিদাস লিখেছেন –' অর্থো হি কন্যা পরকীয়া এব ' । অথাৎ কন্যা মানে পরের ধন । এই মনোভাব থেকেই কন্যা সন্তানকে অপরের হাতে সম্প্রদান করে ক্ষান্ত হতেন কন্যার পিতামাতারা । এর ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রের সার্বিক অগ্রগতি সম্ভব হয়নি । কারন নজরুল তার " নারী " কবিতায় লিখেছেন ,  ' বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির – কল্যাণকর ,/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর । অথচ মেয়েদেরকে সার্বিক উন্নয়নে র সঙ্গে সমন্ধিত না করে তাদের অ সূর্যম্পশা রূপে রেখে তাদের অন্তনিহিত শক্তির অপচয় সাধন করা হয়েছে । তাই তো নজরুল নারীদের আহ্বান জানিয়ে লিখেছিলেন , ' মাথার ঘোমটা ছিড়ে ফেল নারী , ভেঙ্গে ফেল ও শিকল ! দুর করে দাও দাসীর চিহ্ন আছে যত আভরণ ।

তাৎপর্য :–" কন্যাশ্রী " শব্দটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ । কন্যা শব্দের অর্থ হলো তনয়া , দুহিতা , মেয়ে ইত্যাদি । অন্যদিকে " শ্রী " শব্দের অর্থ হলো সুন্দর , লক্ষী , সরস্বতী ইত্যাদি । অথাৎ মেয়েরা এই প্রকল্পের মাধ্যমে হয়ে উঠবে সুন্দর বিদ্বান ও সয়ংস্পূর্ন ( লক্ষী ) । কন্যা সন্তানদের আত্মবিশ্বাসী , সনির্ভর ও সয়ংস্পূর্ন করে গড়ে তুলতে তাদের মধ্যে নিহিত অন্তনিহিত সতার বিকাশ ঘটাতে প্রয়োজন উপযুক্ত পরিকল্পনা সেই পরিকল্পনারই অঙ্গ হলো “ কন্যাশ্রী প্রকল্প ” ।



উদ্দেশ্য :– এই প্রকল্পের প্ররক্ষ উদ্দেশ্যে বহুমুখী হলেও প্রত্যক্ষ উদ্দেশ্যে কিন্তু দ্বিবিধ – মেয়েদের বাল্যবিবাহ রোধ করা এবং তাদের মেধার বিকাশের জন্য বিদ্যালয়মুখী করা । শুধু তাই নয় , শিক্ষাক্ষেত্রে যে " স্কুল ছুট " এর সংখ্যা বাড়ছে তার গতিরোধ করাও এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য । সর্বপরি সমাজের সবাঙ্গিন অগ্রগতিতে মেয়েদেরকে সামিল করতে ও সামাজিক স্থিতিশিলতা ও ভারসাম্য বজায় রাখতে এই প্রকল্পের জুড়ি মেলা ভার ।

লক্ষ্য :– এই প্রকল্পের লক্ষ্য মাত্রা পুরনের জন্য দুটি দিককে সামনে রাখা হয়েছে ।( এক)  অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পাঠরতা ছাত্রীদের যাদের বয়স ১৩ থেকে ১৮ _এর মধ্যে তাদেরকে বছরে পাঁচশত টাকা অনুদান দেওয়া হবে । ( দুই ) যাদের বয়স ১৮ থেকে ১৯ বছর তাদেরকে এককালীন পঁচিশ হাজার টাকা দেওয়া হবে । বাৎসরিক পাঁচশত  টাকা অনুদান দেওয়ার জন্য প্রতি বছরে ১৮ লক্ষ মেয়েদেরকে এই প্রকল্পের সামিল করানো হবে । অন্যদিকে এককালীন অনুদানের জন্য সাড়ে তিন লক্ষ ছাত্রীদের জন্য লক্ষমাত্রা ধার্য করা হয়েছে । তবে যারা এই সুবিধা পাবে তাদের পিতা বা অভিভাবকদের আয় বছরে এক লক্ষ কুড়ি হাজার টাকার বেশি হবে না এবং সন্তানটিকে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রী হতে হবে ।


সুফল :– ২০০৭ –৮ সালের হিসাব অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গ বাল্য বিবাহের ক্ষেত্রে পঞ্চম হওয়ায় কন্যা সন্তানের অপরিনত বয়সে বিবাহ দেওয়ার শিশুমৃত্যু , অপুষ্টি প্রভূতির শিকার হতো । তাছাড়া বিয়ের নাম করে অল্পবয়সী মেয়েদের পাচার হয়ে যাওয়ার হাত থেকে এই প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ । এমনকি মুর্শিদাবাদে (৬১.০৪ ) , বীরভূমে ( ৫৮.০৩ ) , মালদহ ( ৫৬.০৭ ) এবং পুরুলিয়ায় ( ৫৪.০৩ ) কন্যার বয়স আঠারো হওয়ার আগেই বেশিরভাগ মেয়ের বিবাহ সম্পন্ন হয় । এই প্রকল্প সেই বাল্যবিবাহের হারকে কমিয়ে দিতে যে পারবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই । দ্বিতীয় আমাদের রাজ্য যে স্কুল ছুট _এর সংখ্যা বাড়ছে তার মধ্যে মেয়েদের হার বেশি হওয়ায় এই প্রকল্প সেই স্কুলছুটের প্রবণতার হার কমাতে পারবে । তৃতীয়ত কন্যা সন্তান হত্যা বা কন্যা প্রতি অবহেলা তথা বিভেদ সৃষ্টিও এই প্রকল্পের মাধ্যমে অনেকটা স্থিমিত হবে । চর্তুথত , আঠারো বছরের ঊর্ধ্বে মেয়েদের বিয়ে সুনিশ্চিত করতে পারলে মা ও শিশু দের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির ক্ষেত্রে কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সম্ভব হবে ।



বৃহস্পতিবার, ২৩ মে, ২০১৯

বইমেলা রচনা






(সংকেত: ভূমিকা; বইমেলার ইতিহাস, বাংলাদেশে বইমেলা; লেখক, প্রকাশক ও ক্রেতার সুযোগ; বই কেনার আগ্রহ বৃদ্ধি; মেলায় উৎসবমুখর পরিবেশ; পারস্পরিক ভাব বিনিময়; বইমেলার গুরুত্ব; বিচিত্র মানুষজন; একুশে বইমেলা; উপসংহার।)

ভূমিকা: মেলা শব্দটির সাথে আমরা অতি পরিচিত। শত শত বছর ধরে এটি সভ্যতা, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে বুকে ধারণ করে আছে। মেলা যেমন বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে তেমনি এর পৃষ্ঠপোষকরাও হয় বিভিন্ন রকমের। এর মধ্যে বইমেলা সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে নব আবেদন সৃষ্টি করে। বইমেলার প্রচলন খুব প্রাচীন নয়। তবে সম্প্রতি বইমেলার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বইমেলা পাঠকদেরকে বইয়ের প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। মানুষের চিন্তাভাবনা ও জ্ঞানধারণাকে বিস্তৃত করে তোলে, মানুষকে সুখী ও তৃপ্ত করে। বইমেলার মাধ্যমে একটি দেশের সাহিত্য-শিল্প-সাংস্কৃতির সাথে পরিচিত হওয়া যায়। এটি জ্ঞানান্বেষী কোটি কোটি মানুষের জ্ঞান-তীর্থ।


বইমেলার ইতিহাস: ত্রয়োদশ শতকের প্রথম দিকে স্টুর ব্রিজের মেলা অনুষ্ঠিত হয়। ‘বুক সেলার্স রো’ নামে মেলায় বইয়ের অংশগ্রহণও ছিল। ১৮০২ সালে সর্বপ্রথম নিউইয়র্ক শহরে বইমেলার পূর্ণাঙ্গ আসর বসে। এর উদ্যোক্তা ছিলেন ম্যাথু কেরি। ১৮৭৫ সালে একশজন প্রকাশকের ত্রিশ হাজার বই নিয়ে বইমেলার আয়োজন করা হয় নিউইয়র্কের ক্লিনটন শহরে। ১৯৪৯ সালে বিশ্বের বৃহত্তম বইমেলা অনুষ্ঠিত হয় ফ্রাঙ্কফুটে। সেখান থেকেই আধুনিক বইমেলার পদযাত্রা শুরু। প্রতি বছর অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। ফ্রাঙ্কফুট, লন্ডন, কায়রো, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি বইমেলা জনপ্রিয়তার দিক থেকে শীর্ষস্থানে রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই বইমেলার জনপ্রিয়তা বেড়ে চলছে। বইমেলা হয়ে উঠেছে অন্যতম আধুনিক সাংস্কৃতিক উপকরণ। এটি বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি বিকাশের অন্যতম ক্ষেত্র।

লেখক, প্রকাশক ও ক্রেতার সুযোগ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- “কে জানিত মানুষ অতীতকে বর্তমানে বন্ধি করিবে? অতল-স্পর্শ কালসমুদ্রের ওপর কেবল এক-একখানি বই দিয়া সাঁকো বাঁধিয়া দিবে”- আর এই বইয়ের ভান্ডার হলো বইমেলা। ক্রেতারা তাদের পছন্দ অনুযায়ী বই ক্রয় করতে পারে। বিভিন্ন স্টলগুলোতে ঘুরেফিরে হাতে নিয়ে বই দেখতে পারে। যার ফলে বিভিন্ন অচেনা অজানা বই সম্পর্কে একটু হলেও ধারণা পাওয়া যায়। মেলায় লেখক ও প্রকাশকেরা নতুন জীবনের খোঁজ পায়। তারা বছরের এই সময়টির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে নিজের সৃষ্টিশীলতাকে সবার কাছে উন্মুক্ত করে দেওয়ার জন্য। লেখক, প্রকাশক এবং ক্রেতা বইমেলায় এসে জীবনের স্বাদ আস্বাদন করে। কেউ মুক্ত চিন্তাধারা বিলিয়ে দেয় আবার কেউ তা কুড়িয়ে নেয়।

বই কেনার আগ্রহ বৃদ্ধি: ভিনসেন্ট স্টারেট বলেছেন- ''When we buy a book we buy pleasure'' অনন্ত বিশ্বে জ্ঞান ও ভাবের অপূর্ব সমন্বয় হলো বইমেলা। মেলায় প্রকাশকরা বিভিন্ন স্টল খোলেন এবং নিজেদের পছন্দের বই সাজিয়ে রাখেন থরে থরে। ফলে সেখান থেকে ক্রেতা অতি সহজেই কাঙক্ষিত বইটি কিনে নিতে পারে। বইমেলায় মূল্য ছাড় দেওয়া হয় যা বই ক্রয়ে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে। এ সুযোগটি কাজে লাগিয়ে অনেক ক্রেতাই বেশি করে বই কেনে। মেলায় লেখক ও প্রকাশকের উপস্থিতি ক্রেতাদের বই কেনার উৎসাহ বাড়িয়ে তোলে। পছন্দের লেখককে হাতের কাছে পেয়ে পাঠক আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। এ সময় অটোগ্রাফ নিতেও কেউ ভুল করে না।

মেলায় উৎসবমুখর পরিবেশ: পারস্যের কবি ওমর খৈয়াম বলেছেন- “রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে; কিন্তু একখানা বই অনন্তযৌবনা যদি তেমন বই হয়।” সেই অনন্তযৌবনা বইটির খোঁজ পাওয়া যাবে বইমেলা নামক বইয়ের রাজ্যে। যেখানে পাঠক রুচিশীল ও মনোরম পরিবেশে পছন্দের বইটি কিনে মনের খোরাক জোগাতে পারবে। বইমেলায় একটি নির্দিষ্ট পরিসরে সব রকম বইয়ের সমাবেশ থাকায় ক্রেতারা অল্প পরিশ্রমে এবং অল্প সময় ব্যয় করে নিজ নিজ চাহিদা অনুযায়ী বই সংগ্রহ করতে পারে। বইমেলায় শুধু বই-ই পাওয়া যায় তা নয় বইমেলা হয়ে ওঠে বিনোদন কেন্দ্র। বিভিন্ন ধরণের অনুষ্ঠান, গানের আসর, কবিতা আবৃত্তির আসর, আলোচনা সভা, মঞ্চ নাটক ইত্যাদি মেলার সৌন্দর্যবর্ধন করে। বইমেলার উন্মুক্ত ও রুচিশীল পরিবেশ পাঠক-দর্শককে বিস্মিত ও আনন্দিত করে।



পারস্পরিক ভাব বিনিময়: বইমেলা হলো মানুষের মিলনমেলা। ব্যস্ত নাগরিক জীবনের একঘেঁয়েমি দূর করে বইমেলা এনে দেয় প্রশান্তি। উন্মুক্ত পরিবেশে ক্রেতারা একে অপরের পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টি লক্ষ্য করে এবং তা নিয়ে আলোচনাও করে। বড়দের সাথে সাথে ছোটরাও বইমেলাকে দারুণভাবে উপভোগ করে। বইমেলায় প্রকাশকরা সরাসরি পাঠকদের চাহিদার দিকে দৃষ্টি রাখতে পারে এবং চাহিদা অনুযায়ী নতুন বই প্রকাশে উদ্বুদ্ধ হয়। এছাড়া লেখক ও প্রকাশকরা নিজেদের মধ্যে ভাব-বিনিময়ের সুযোগ পান। সমসাময়িক বিভিন্ন সমস্যা এবং তা সমাধানের উপায় নিয়েও আলোচনা করেন। বইমেলায় ভক্তরা তাদের প্রিয় লেখকের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করার সুযোগ পায়।

বইমেলার গুরুত্ব: বই মানুষের পরম বন্ধু, মানব সভ্যতার অন্যতম প্রাণসভা। বই অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মাঝে তৈরি করে সেতুবন্ধন। বই সত্যের পথে, ন্যায়ের পথে পরিচালিত করে মানুষকে বিশুদ্ধ করে তোলে। ম্যাক্সিম গোর্কি বলেছেন- “আমার মধ্যে উত্তম বলে যদি কিছু থাকে তার জন্যে আমি বইয়ের কাছে ঋণী।” মানুষ জ্ঞানতৃষ্ণা নিবারণের জন্য বইমেলায় ছুটে যায়। বইমেলায় প্রতিদিনের ব্যস্ততা ভুলে মানুষ আনন্দস্রোতে অবগাহন করে। বইমেলার আসল উদ্দেশ্য হলো বইকেনায় মানুষকে আগ্রহী করে তোলা। লেখক ও নাট্যকার মমতাজউদ্দিন বলেছেন-''The importance of a book fair must be duly understood by the people of our country, and then we can flourish ourselves'' বইমেলায় বইয়ের সান্নিধ্য ছাড়াও বইপ্রেমীরা পায় সৃষ্টি সুখ। নবীন লেখকদের আত্মবিকাশের উৎসাহ জাগ্রত হয়। বইমেলাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়। কর্মমুখী মানুষ যারা বই কেনার সময় পায় না তারাও মেলার টানে বইমেলায় গিয়ে হাজির হয়। পরিবারের সবাইকে নিয়ে আনন্দে মেতে উঠে।

বিচিত্র মানুষজন: বইমেলায় বিভিন্ন বয়সের বিচিত্র মানুষের সমাবেশ ঘটে। ক্রেতাদের কেউ কবিতার বই পড়তে পছন্দ করে, আবার কেউ গল্প-উপন্যাসের বই, কেউ নাটকের বই নিয়েই সন্তুষ্ট আবার কেউ ভ্রমণকাহিনী ভালোবাসে। ছোটদের মধ্যে কারও পছন্দ ছড়ার বই আবার কারও মজার মজার ছোট গল্পের বই। ছোট-বড় অনেকেরই গোয়েন্দাকাহিনী প্রিয়। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে ছেলে, বুড়ো, শিক্ষক, জ্ঞানী-গুণী সকলেই বইমেলায় আসে। চোখে পড়ে ছোট শিশুর বইয়ের প্যাকেট হাতে দুরন্তপনা। কোথাও কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে জ্ঞানান্বেষীর মন্থর গতি। চা, কফি ও তল পানীয়ের দোকানে পাঠক ও দর্শকদের ভিড়।

একুশে বই মেলা: খুব চেনা পরিবেশ, শত প্রাণের উদ্দীপ্ত উপস্থিতি, নতুন বইয়ের গন্ধ এই হলো আমাদের একুশে বই মেলা। ভাষা শহিদদের স্মরণে আয়োজিত বাঙালির প্রাণের মেলা অমর একুশে গ্রন্থমেলা। এই গ্রন্থমেলা বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রেরণার উৎস। বাংলা একাডেমির উদ্যোগে একাডেমি প্রাঙ্গণে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। বইমেলার ঐতিহ্যমন্ডিত প্রাঙ্গণ এটি। নীরব বাংলা একাডেমী সরব হয়ে উঠবে বইপ্রেমীদের প্রাণবন্ত উপস্থিতিতে। ২০১৪ সালে সেই প্রাণস্পন্দন ছড়িয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহনকারী সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনেও। অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাঙালির বৃহত্তম জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।




উপসংহার: জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বইমেলার জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বইমেলায় এসে মানুষ আবিষ্কার করে। একটি মুক্ত পরিবেশ যেখানে তার আত্মার সঙ্গীটির খোঁজ পাওয়া যায়। জীবনের স্বাদ নেয়ার জন্য সকলেই বইমেলায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তাই সবসময় বইমেলায় দেখা যায় উপচে পড়া ভিড়। আমাদের দেশেও এর জনপ্রিয়তা খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।