বৃহস্পতিবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৯

চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞান বাংলা রচনা






ভূমিকা: আধুনিক সভ্যতার যাবতীয় অগ্রগতির মূলে আছে বিজ্ঞানের বিস্ময়কর সব আবিষ্কার। আক্ষরিক অর্থে বিজ্ঞান হলো, বিশেষ জ্ঞান। আর এই বিশেষ জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে প্রকৃতির রহস্য উম্মোচন করে মানবকল্যাণে নতুন নতুন আবিষ্কার করাই বিজ্ঞানের কাজ। আধুনিক সভ্যতার এই পর্যায়ে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সর্বত্রই বিজ্ঞানের জয়জয়কার। বিশেষত চিকিৎসাক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সাধন করেছে বিজ্ঞান। চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞানের আর্শীবাদে মানুষ অনেক জটিল ও দূরারোগ্য ব্যাধিকে জয় করতে সক্ষম হয়েছে।

চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞান: “Health is Wealth” অর্থাৎ স্বাস্থ্যই সম্পদ। কেননা প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক হয়েও স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে সুখী হওয়া যায় না। আর সুস্বাস্থ্যের নিশ্চয়তার জন্য চাই উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা। চিকিৎসাশাস্ত্রে নতুন নতুন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে সুস্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা। বিজ্ঞানের আর্শীবাদে আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা চরম উৎকর্ষের দিকে এগিয়ে গেছে। চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রগতি ক্রমাগত মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়িয়ে দিচ্ছে।

প্রাচীন চিকিৎসা ব্যবস্থা: প্রাচীন কালে মানুষ রোগবালাইকে স্রষ্টার অভিশাপ কিংবা অশরীরী শক্তির অশুভ দৃষ্টি বলে মনে করতো। রোগ মুক্তির কোনো উপায় তাদের জানা ছিল না। ফলে রোগ-বালাই, দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে আদি মানবেরা নির্বিচারে মারা পড়ত। পরবর্তীতে মানুষ রোগের হাত থেকে মুক্তি পেতে লতাপাতা, তাবিজ-কবচ, পানিপড়া, ঝাড়-ফুঁক প্রভৃতির উপর নির্ভর করা শুরু করে। এই অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতিকে একত্রে বলা হয় কবিরাজি চিকিৎসা ব্যবস্থা। এই কবিরাজি চিকিৎসা ব্যবস্থার ভিত্তিমূল হচ্ছে ধর্মীয় বিশ্বাস, এবং কুসংস্কার।

আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার উদ্ভব ও বিকাশ: সপ্তম শতাব্দীর কিছু পূর্বে সনাতন চিকিৎসা ব্যবস্থার পাশাপাশি ইউনানী চিকিৎসা ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে। যদিও সর্বপ্রথম গ্রীসে এর উৎপত্তি, তবে আরবের মুসলিম চিকিৎসকেরা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। এক্ষেত্রে ইবনে সিনা, আল রাজি প্রমুখ মনীষীদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। ১৮১০-১৮৩৯ মধ্যবর্তী সময়কালে জার্মান বংশোদ্ভুত চিকিৎসক স্যামুয়েল হ্যানিম্যানের আবিষ্কৃত হোমিওপ্যাথি আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে। সর্বোপরি আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটেছে আঠারো শতক থেকে উনিশ শতকের মধ্যবর্তী সময়কালে। মূলত আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি পুরোপুরি বিজ্ঞান নির্ভর।

চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদান: উনিশ শতকে উদ্ভব ঘটলেও চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কারগুলোর বেশিরভাগই হয়েছে বিশ শতকে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উল্লেখযোগ্য অবদানগুলোর মধ্যে আছে- কালাজ্বরের জীবাণু আবিষ্কার (১৯০০), সহযোগী হৃৎপি- আবিষ্কার (১৯০৮), কোলেস্টেরল (১৯১২), পেনিসিলিন (১৯২৮), রক্তরস আবিষ্কার (১৯৪০), কিডনী ডায়ালাইসিস মেশিন (১৯৪৩), ডিএনএ (১৯৫৩), পেসমেকার (১৯৫৩) ইত্যাদি। এ ছাড়াও ক্লোরোমাইসিন, স্ট্রেপটোমাইসিন, ওপেন হার্ট সার্জারি ও বাইপাসের সহযোগী যন্ত্রপাতি আবিষ্কার চিকিৎসা বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ অবদান। শব্দ তরঙ্গ ও আলোকরশ্মির সাহায্যে অস্ত্রোপচার না করেই মূত্রথলি ও পিত্তকোষের পাথর চূর্ণ করা চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অভাবনীয় সাফল্য। দূরারোগ্য ঘাতক ব্যাধি এইডসএর জীবাণু আবিষ্কার (১৯৮৪), আধুনিক কন্টাক্ট লেন্স (১৯৫৬) ছাড়াও ১৯৭৮ সালে সর্বপ্রথম টেস্টটিউবের মাধ্যমে মানব শিশুর জন্ম এবং ১৯৯৭ সালে ভেড়ার দেহকোষের সাহায্যে পূর্ণাঙ্গ শিশু ভেড়া ডলির জন্মগ্রহণের মাধ্যমে চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান বিপ্লব ঘটিয়েছে। এতো সবের পরেও বিজ্ঞান থেমে থাকেনি বরং উত্তরোত্তর চিকিৎসা ক্ষেত্রে নানা আবিষ্কার অব্যাহত রেখেছে।

রোগ নির্ণয়ে বিজ্ঞান: রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান অনবদ্য সাফল্যের দাবিদার। রঞ্জনরশ্মি, এক্সরে, আলট্রাসনোগ্রাফি, ইসিজি, সিটি স্ক্যান, লেজার, মাইক্রোস্কোপ প্রভৃতি যন্ত্র আবিষ্কারের ফলে রোগ নির্ণয় অনেক সহজ হয়ে গেছে। আলট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে যকৃত, কিডনি, পিত্তথলিসহ শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অবস্থা নিরুপণ করা সম্ভব। আলোক তন্তু বা ফাইবার অপটিকস্ এর সাহায্যে ফুসফুস, পাকস্থলী, শিরা, ধমনী, বৃহদন্ত, ক্ষুদ্রান্ত্র প্রভৃতির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে সঠিক রোগ নির্ণয় করা যায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের যুগান্তকারী পরিবর্তনের ফলে ক্যান্সার, টিউমার প্রভৃতি দূরারোগ্য ব্যাধি সহজেই ধরা পড়ছে, যথাসাধ্য চিকিৎসা প্রদান সম্ভব হচ্ছে। রক্ত এবং মূত্র পরীক্ষার মাধ্যমে তৎক্ষণাৎ রোগ নির্ণয় করা যাচ্ছে।

রোগ প্রতিরোধে বিজ্ঞান: বিজ্ঞানের সহায়তায় রোগ প্রতিরোধেরও বিভিন্ন পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। শিশুদের আটটি মারাত্মক রোগ পোলিও, ইনফ্লুয়েঞ্জা, হেপাটাইটিস-বি, যক্ষ্মা, হাম, হুপিং কাশি, ডিপথেরিয়া এবং ধনুষ্টংকারের প্রতিরোধক টীকা আবিষ্কারের ফলে শিশু মৃত্যুর হার অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া বসন্ত, জরায়ু ক্যান্সার প্রভৃতি জটিল রোগের প্রতিরোধক টীকা আবিষ্কার মানুষকে স্বস্তি দিয়েছে। অন্যদিকে, মাতৃত্বকালীন বিভিন্ন টীকা মাতৃ মৃত্যু হ্রাস ও নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে সহায়তা করছে।

রোগ নিরাময়ে বিজ্ঞান: চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের আর্শীবাদেই অনেক দূরারোগ্য ও জটিল রোগ থেকে মানুষ মুক্তি লাভ করছে। এমনকি অধ্যাপক কুরি ও মাদাম কুরি আবিষ্কৃত রেডিয়ামের সাহায্যে ক্যান্সারের মতো ঘাতক ব্যাধিরও চিকিৎসা সম্ভব হচ্ছে। আগুনে পোড়া কিংবা অ্যাসিড দগ্ধ মানুষকেও প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে স্বাভাবিক আকৃতি দেয়া সম্ভব হচ্ছে বিজ্ঞানেরই অবদানের ফলে। অন্যদিকে দুর্ঘটনায় অঙ্গহানি ঘটলেও বর্তমানে মানুষকে আর পঙ্গু হয়ে জীবনযাপন করতে হচ্ছে না কেননা বিজ্ঞানের আর্শীবাদে মানবদেহে কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন করার মতো অবিশ্বাস্য কাজটিও সম্ভব হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে কোনো রোগই চিকিৎসা বিজ্ঞানের আওতার বাইরে থাকবে না।

ওষুধ শিল্পে বিজ্ঞান: চিকিৎসার অপরিহার্য অঙ্গ হলো ওষুধ। বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলেই পেনিসিলিনের মতো মহৌষধ আবিষ্কৃত হয়েছে। এছাড়াও জ্বর, কাশি, সর্দি, মাথাব্যাথা, গ্যাসট্রিক প্রভৃতি সাধারণ অসুখ-বিসুখের জন্যেও নানা ধরণের ওষুধ আবিষ্কার করেছে বিজ্ঞান। বর্তমানে বিভিন্ন ধরণের ওষুধ আবিষ্কারের ফলে চিকিৎসাক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উম্মোচিত হয়েছে। ওষুধ আবিষ্কারে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ফলে অনেক জটিল রোগে অস্ত্রোপচার না করে কেবল ওষুধের মাধ্যমে রোগ নিরাময় করা যাচ্ছে।

চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞানের গুরুত্ব: চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদান মানব সভ্যতার অগ্রগতির ক্ষেত্রে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞানের আবিষ্কারের পূর্বে রোগে, দুর্ঘটনায় প্রতিনিয়ত মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ত। মহামারীর কবলে পড়ে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অপরিমেয় অবদান মানুষকে অকাল মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছে; দিয়েছে সুখী, সমৃদ্ধ, সুস্থ জীবন। আর শারীরিকভাবে সুস্থ এসব মানুষই দেশ ও জাতিকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অসুস্থ, অথর্ব মানুষ জাতিকে ভালো কিছু দিতে অক্ষম।

উপসংহার: প্রকৃতপক্ষে, চিকিৎসা ক্ষেত্র আজ পুরোপুরি বিজ্ঞান নির্ভর। রোগ-ব্যাধি-জরা থেকে মুক্তি পেতে প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের যে সাধনা, তা সফল হয়েছে বিজ্ঞানের সহায়তায়। মানুষ এখন আর বিনা চিকিৎসায়, রোগে কাতর হয়ে অকাল মৃত্যুকে বরণ করে নেয় না বরং বিজ্ঞান-ভিত্তিক চিকিৎসার আশ্রয়ে রোগমুক্তির চেষ্টা করে। বলতে গেলে, চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞানের এই অগ্রগতির ফলে মানুষ প্রায় সকল রোগ-ব্যাধিকেই জয় করে ফেলেছে। মোটকথা, অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো চিকিৎসা ক্ষেত্রেও বিজ্ঞান বিপ্লব সাধন করেছে।






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন