শুক্রবার, ৪ অক্টোবর, ২০১৯

সমাজসেবা বাংলা রচনা





ভূমিকা: মানুষ যেদিন থেকে গুহাবাস ছেড়ে সমাজবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল জীব হিসেবে বসবাস করতে অভ্যস্ত হলো, সেদিন থেকে এক বৃহত্তর মঙ্গল কামনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার অঙ্গীকার গ্রহণ করলো। মানুষ আজ সভ্যতার চরম শিখরে আরোহন করছে। আর এটা মানুষের একক প্রচেষ্টায় সম্ভব হয়নি বরং যুগ যুগান্তর ধরে চলে আসা মানব সম্প্রদায়ের বৃহত্তর স্বার্থ অর্জনের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। সমাজজীবন মাত্রই সহযোগিতা, সহিষ্ণুতা, মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ ও প্রতিফলন। সমাজ সেবার মাধ্যমে একটি কর্মমুখর, সচল ও উন্নত সমাজ গঠন করা সম্ভব। সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর মধ্যেই জীবনের যথার্থ সার্থকতা নিহিত। অপরের কল্যাণ কামনাকে প্রাধান্য দিয়ে নিজের স্বার্থকে ত্যাগ করার নামই সমাজসেবা।

সমাজসেবার বৈশিষ্ট্য: প্রখ্যাত কবি কামিনী রায় তাঁর ‘পরার্থে’ কবিতায় যথার্থই উল্লেখ করেছেন-

‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবনী পরে,
সকলের তরে সকলে আমরা
প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।’সমাজে একসাথে বাস করতে গেলে কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য ব্যক্তির উপর আপনা আপনিই বর্তায়। প্রকৃত সামাজিক জীব হিসেবে প্রত্যেক মানুষের উচিত স্ব স্ব অবস্থান থেকে যথাসাধ্যভাবে এসব দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো পালন করা। বৃহত্তর জনগোষ্ঠির কল্যাণ কামনাই সমাজ সেবা। যে বিশ্বমানব গোষ্ঠির জন্য নিজেকে নিবেদিত রাখে সেই প্রকৃত মহৎ হৃয়ের মানুষ। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন- ‘আপনা রাখিলে ব্যর্থ জীবন সাধনা/জনম বিশ্বের তরে পরার্থে কামনা।’ পাশ্চাত্য মনীষী Ruskinবলেন- “There are three kinds of duties; duties towards God, duties towards Parents and duties towards mankind.”

সমাজ সেবার ধর্মীয় মূল্যবোধ: বিভিন্ন ধর্মে সমাজ সেবাকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়েছে। বিশ্বনবী হযরত মুহম্মদ (স.) বলেছেন- ‘মানুষের মধ্যে তিনিই শ্রেষ্ঠ যিনি মানুষের উপকার করেন। মানব সেবা সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ বলে গেছেন- ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’। মানবতার কল্যাণ সাধনের মহান ব্রতে উদ্বুদ্ধ হয়ে মহাপুরুষ বুদ্ধদেব সংসার জীবন, সুখ-ঐশ্বর্য ও সাম্রাজ্য সব কিছুর সাথে যোগাযোগ ছিন্ন করে পথে বের হয়েছিলেন। বিভিন্ন ধর্ম শাস্ত্র-, প্রবিত্র কুরআনে, রামায়ন-মহাভারতে, মহাকাব্যে, পুরাণে সমাজ সেবা তথা জনসেবাকেই শ্রেষ্ঠ ধর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।

সমাজ সেবার গুরুত্ব: পারস্য কবি শেখ সাদী বলে গেছেন-

সেজদা ও তসবিহ দেখে, খোদ এলাহি ভুলবে না
মানবসেবার কুঞ্জি ছাড়া স্বর্গদ্বার খুলবে না’সুতরাং একথা অকপটে বলা যায় যে, ইহলৌকিক ও পরলৌকিক মুক্তির পথ নিশ্চিত করতে সমাজ সেবার গুরুত্ব অপরিসীম। মানবতার সেবা তথা সমাজসেবার মাধ্যমেই জীবনের প্রকৃত আত্মতৃপ্তি লাভ করা যায়। সমাজসেবার মহান ব্রতে সবাই একতাবদ্ধভাবে এগিয়ে আসলে সমাজের রূপই পাল্টে যায়, যার প্রভাব উন্নত দেশ ও জাতি গঠনে ব্যাপক কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। অন্যের কল্যাণ কামনায় নিয়োজিত করতে পারার মধ্যেই মানুষের জীবন সুখময় ও আনন্দময় হয়ে ওঠে। যে জাতি যতো সমৃদ্ধ ও উন্নত তাদের মধ্যে জাতীয় ঐক্য ও সমাজসেবার প্রবণতা ততো বেশি।

সমাজসেবার ধরণ ও পদ্ধতি: রজনীকান্ত সেন সমাজসেবার পরিচয় ও পদ্ধতি উল্লেখ করে বলেছেন:

‘অন্নহীনে অন্নদান, বস্ত্রহীনে বস্ত্রদান তৃষ্ণাতুরে জল দান,
ধর্ম ধর্মহীনে, মুর্খজনে বিদ্যাদান,
বিপন্নে আশ্রয়, রোগীর ঔষধ দান,
ভয়ার্তে অভয়, গৃহহীনে গৃহদান,
অন্ধেরে নয়ন, পীড়াতে আরোগ্যদান,
শোকার্তে সান্তনা, স্বার্থ শূণ্য হয়
যদি এ দ্বাদশ দান
স্বর্গের দেবতা নহে দাতার সমান’।সমাজে কেউ বিত্তবান, আবার কেউ অসহায়। যারা সম্পদশালী তারা আর্থিকভাবে সাহায্য দিয়ে সমাজের দীন-দুঃখীদেরকে সাহায্য করতে পারে। আর যাদের সে সামর্থ্য নেই, তারা সান্তনা দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে, অসুস্থকে সেবা দিয়ে, সাধ্যমতো শ্রম দিয়ে অপরের কল্যাণে নিজেকে নিবেদিত করতে পারে। সমাজসেবা করতে যখন বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের লোক একতাবদ্ধ হয় তখন সমাজে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে সঙ্গতি রেখে পাঠ কার্যক্রম পরিচালনা ও স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যথা-অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, বন্যা, ভূমিকম্প-এসবের সময় জনসাধারণের পাশে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে এবং পূর্ব থেকে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্ঠায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

রাজনৈতিক দল ও সমাজ সেবা: সমাজ সেবার সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর এক নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। সমাজসেবা করার এক অন্যতম মাধ্যম হতে পারে রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক দলগুলো জনবল, প্রশাসনিক ও আর্থিক সব দিক দিয়েই ক্ষমতাসম্পন্ন। তারা যদি ন্যায়-নিষ্ঠার সাথে এসব ক্ষমতাকে কাজে লাগায় তাহলে সমাজে মানুষ উপকৃত হবে। আর তারা যেহেতু জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হন সেহেতু জনগণের কল্যাণসাধনা তাদের ক্ষমতা অর্জনের প্রধান ব্রত হওয়া উচিত। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ প্রতিশ্রুতিমূলক কথাবার্তা আর আশার আলো দেখিয়ে ক্ষমতা অর্জন এবং অধীকৃত ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার দিকেই তাদের প্রাণান্ত প্রচেষ্ঠা।

সমাজসেবার নিয়মিত চর্চা: সভা-সমাবেশ, সিম্পোজিয়াম, পোস্টার ছাপানোসহ বিভিন্নভাবে জনমনে সমাজসেবা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সমাজ সেবা প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা একটি প্রথা। যুগের বিবর্তনে সমাজ ক্রমশ বিকাশ ও উন্নতি লাভ করছে। সমাজ সেবার প্রবণতা যদি প্রাচীন আমল থেকে প্রচলিত না থাকতো তাহলে বর্তমানে আমরা এমন সুসভ্য সমাজজীবন উপভোগ করতে পারতাম না।

মহান আদর্শ: সমাজসেবার ক্ষেত্রে বাংলার ক্ষুদিরাম, নূর হোসেন, হাজী মুহম্মদ মহসীন, শেরে বাংলা ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, আফ্রিকার বর্ণপ্রথা বিরোধী বিশ্বখ্যাত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, আর্জেন্টিনার চে গুয়েভার প্রমুখ মহান নেতার নাম উল্লেখযোগ্য। জনকল্যাণে আত্মনিয়োগ করার মাধ্যমেই ইতিহাসে তারা চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তারা শুধুমাত্র অর্থদিয়ে নয়, নিঃস্বার্থভাবে জীবন দিয়ে মানবকল্যাণে আত্মনিয়োগ করে গেছেন। এসব মহৎপ্রাণ ব্যক্তির জীবনাদর্শ অনুসরণ করে সমাজসেবায় আমরা নিজেদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে পারি।

আন্তর্জাতিক সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা:বিশ্বব্যাপী মানুষের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পৃথিবীর সবদেশে সমাজসেবার ধারণা জনপ্রিয়তা লাভ করছে। সামাজিক সুযোগ-সুবিধাগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে বিশ্বব্যাপী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান। এদের মধ্যে OIC, RED CRESENT SOCIETY, UNO, UNICEF, UNESCO প্রভৃতি সংস্থার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আমাদের দেশীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন এনজিও, রামকৃষ্ণ মিশন, বাঁধন ইত্যাদি।

উপসংহার: সমাজসেবায় মনুষ্যত্বের বিকাশ লাভ হয়। সমাজসেবার মাধ্যমে একজন অপর জনের কাছাকাছি আসতে পারে। ফলে সমাজে মানুষের সাথে মানুষের আত্মার বন্ধন গড়ে ওঠে। নিঃস্বার্থ সমাজসেবা মানুষের অনিন্দ্য সুন্দর গুণাবলির একটি। প্রত্যেক মানুষের উচিত নিজের ভিতরে লুকিয়ে থাকা হিংসা-বিদ্বেষ, কপটতা-ভন্ডমি, এসব কুপ্রবৃত্তিকে শক্ত হাতে দমন করে সমাজসেবার মহান আদর্শে নিজেকে পরিচালিত করা।






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন