রচনা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
রচনা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

শুক্রবার, ২৭ আগস্ট, ২০২১

করোনা ভাইরাস বাংলা রচনা



ভূমিকা : বিজ্ঞান প্রযুক্তির বলে মানব সভ্যতা যতই উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছাক না কেন , প্রকৃতির হাতে মানব সভ্যতার দার বাঁধা আছে । বারবার তাঁর প্রমান দিয়ে যায় প্রকৃতি , কোন কোন সময় বন্যা , কোন কোন সময় মহামারী , ভূমিকম্প ইত্যাদির মধ্য দিয়ে । বর্তমানে আমরা সকলেই নতুন এক বৈশ্বিক মহামারীর প্রকপের সম্মুখীন হয়েছি  , যাঁর নামকরণ করা হয়েছে ( Covid - 19 ) । বিশ্বজুড়ে এক আতঙ্কের বার্তাবরণ ছড়িয়ে পড়েছে । যে প্রকৃতি সৃষ্টির মূলে , আবার সেই প্রকৃতিই সেজে ওঠে মারণ সাজে , যাঁর প্রকোপে পড়েছে মানব সভ্যতা । 


ভাইরাসের আবিষ্কার : করোনা ভাইরাস সর্ব প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৯৬০ সালে  , তবে করোনা ভাইরাসের সন্দেহ মেলে ১৯৩০ সালে । করোনা ভাইরাস প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিল মালয়েশিয়ায় । WHO ইমারুল ভাইরাসটির নাম দেয় Covid - 19 , ৭ই জানুয়ারী ২০২০ সালে । Corona শব্দটি ল্যাটিন শব্দ । Covid - 19 নামকরণটি বিন্যাস হল , CO দিয়ে Corona , VI দিয়ে Virus , D দিয়ে Disease বোঝানো হয়েছে । এবং এই ভাইরাসটি ছড়ায় ২০১৯ সালে , তাই ১৯ নাম দেওয়া হয়েছে । এখনো পর্যন্ত ৭  গোত্রের প্রজাতির ভাইরাসের নাম পাওয়া গেছে । 

1) HCOV - 229E  2) HCOV - NI63 3) HCOV - OC43 4) HCOV - HKU1 5) MERS - COV 6) SARS - COV 7) SARS - COV-2   

WHO এই পর্যন্ত তিনটি বৈশ্বিক মহামারীর ঘোষণা করেন , তাঁর মধ্যে অন্যতম হল COVID - 19 | 



ভাইরাসের শনাক্ত : ৩১শে ডিসেম্বর ২০১৯ সালে , চীনের উহান শহরে ভাইরাসের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় । WHO কোভিড ১৯ ke পেন্ডেমিক হিসেবে ঘোষণা করেন ১১ ই মার্চ ২০২০ । কোভিড ১৯ রোগটির বহনকারী ভাইরাস টি হল SARS - COV-2   । বিজ্ঞানীরা ৯ই জানুয়ারী ২০২০ সালে কোভিড ১৯ কে SARS গোত্রের ভাইরাস হিসেবে চিহ্নিত করেন ।


ভাইরাসের নামকরণ : এই ভাইরাসটির আকৃতি মুকুট এর মতো তাই নামকরণ হয়েছে করোনা । ২০১৯ সালে ভাইরাসটির প্রবল মাত্রায় ছড়ায় তাই 19 নামকরণ করা হয়েছে । বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মহামারী রূপ ধারণ করেছে এই ভাইরাস । এই ভাইরাসটির 50 - 200 ন্যানো
মিটার । এই ভাইরাসের চার ধরনের প্রোটিন পাওয়া যায় । এবং ভাইরাসটি RNA প্রকৃতির 


ভাইরাসের উৎপত্তি : ভাইরাসটি কীভাবে প্রথম কোথায় ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর সঠিকভাবে ব্যাখ্যা এখনো পর্যন্ত দেওয়া যায়নি । তবে অনুমানের বিচারে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর , চীনের উহান প্রদেশের মানুষের মধ্যে সংক্রমণ হতে দেখা যায় । এবং আস্তে আস্তে এর আকার মহামারী রূপ ধারণ করে । চীনের প্রথম করোনা রোগীর মৃত্যু হয় ১১ জানুয়ারী ২০২০ সালে । করোনা ভাইরাস নিয়ে সর্তককারি চিকিৎসকের নাম লি ওয়েন লিয়াং । এই চিকিৎসকের মৃত্যু ঘটে ৫ জানুয়ারী ২০২০ সালে । এই ভাইরাসের কবলে পড়েছে ২৩১ টি দেশ ।



করোনা ভাইরাসের লক্ষণ : WHO এর নির্দেশনামা অনুযায়ী এই রোগের লক্ষণ গুলি হল জ্বর , কাশী , নাক দিয়ে জল পড়া , শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি । প্রাথমিক ভাবে আক্রান্ত ব্যাক্তির প্রথমে জ্বর , গলা ব্যাথা আসতে আসতে শ্বাসকষ্টের প্রদাহ ইত্যাদি লক্ষণ গুলি ২ - ১৪ দিনের মধ্যে প্রবল আকার ধারণ করে । আক্রান্ত ব্যাক্তির হাঁচি - কাশীর মধ্য দিয়ে এ ভাইরাসটি মানব শরীরে ছড়িয়ে পড়ে । যেকোনো বয়সের মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে । তবে বৃদ্ধ মানুষ ও দুর্বল ব্যাক্তির মধ্যে এই রোগের পার্দুভাব প্রবল । RT PCR  এই পরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগ সনাক্ত করা হয় । করোনা ভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষার জন্য নাক ও গলার নমুনা সংগ্রহ করার বিশেষ কাঠের নাম সোয়াব স্টিক ।



করোনা ভাইরাসের চিকিৎসা পদ্ধতি : এই রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি এখনো পর্যন্ত আবিস্কার করা যায়নি , তবে স্যানিটাইজার , মাস্ক , গরম পানীয় , এবং প্রোটিন জাতীয় খাদ্য , সঙ্গে ফল ভিটামিন , C জাতীয় খাদ্য আক্রান্ত রোগীকে দেওয়া হয় । 


করোনা ভাইরাসের ভ্রান্ত ধারণা : গোমূত্র সেবন এবং করুণা মাতার পূজো দেওয়া , এর ফলে নাকি করুণার কবল থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে । গরম ও আর্দ্র অঞ্চলে ভাইরাস ছড়ায় না , ইত্যাদি ভ্রান্ত ধারনা গুলি মানুষের মধ্যে প্রচারিত হয়েছে ।


বিশ্বের করোনার প্রভাব :  পৃথিবীর রথচাকা যেন আজ থমকে গেছে বিশ্ববাসী আজ গৃহবন্দি । এই মরণ ভাইরাস বা অতিমারিকে রক্ষা করার জন্য দেশব্যাপী পালন করা হচ্ছে লকডাউন । ভারতে ২২ শে মার্চ ২০২০ থেকে প্রথম ধাপের লকডাউন শুরু হয় । আমেরিকা , ইতালি , চিন , বিশ্বের ধনী দেশগুলোও করোনার প্রকাপে প্রকপিত । সারা বিশ্বের মোট ১০ কোটির উপরে লোক করোনার প্রকাপের সম্মুখীন হয়েছে । ভারতের যে রাজ্য গুলি করোনা ভাইরাসের প্রকাপের প্রথম স্থানে রয়েছে তাঁর নাম হল মহারাষ্ট্র , অন্ধপ্রদেশ , কর্ণাটক , তামিনাড়ু , দিল্লি , উত্তর প্রদেশ , পশ্চিমবঙ্গ ।



উপসংহার : COVID 19 করাল গ্রাস থেকে মুক্তির পন্থা হিসেবে নিজের সচেতননা ও সক্রিয়তা ,অবলম্বনের মধ্য দিয়ে আমরা অতিমারিকেও জয় করতে সক্ষম হবো ।

 

বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০২০

প্রতিবেশীর প্রতি কর্তব্য বাংলা রচনা



ভূমিকা: মানুষ সামাজিক জীব। সে একা বসবাস করতে পারে না। সমাজবদ্ধ হয়ে পাড়া- প্রতিবেশীর সাথে মিলেমিশে বসবাস করা মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য। ঘরের পাশে ঘর, বাড়ির পাশে বাড়ি এবং পরিবারের পাশে অন্য একটি পরিবার অবস্থিতির মাধ্যমে পাড়া বা মহল্লা গড়ে উঠে। এভাবে যারা পাশাপাশি বসবাস করে তারা পরস্পরের প্রতিবেশী। মানব জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ- বেদনায় তারা এগিয়ে আসে। এ জন্য প্রতিবেশীদের প্রতি আমাদের অনেক দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে।
প্রতিবেশী কারা: সাধারণ অর্থে আমাদের আশেপাশে বসবাসকারীদের প্রতিবেশী বলা হয়। এ প্রসঙ্গে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেন- “আশেপাশে চল্লিশ বাড়ি পর্যন্ত সকলেই প্রতিবেশী।” অর্থাৎ নিজ গৃহের সম্মুখ, পশ্চাৎ, ডান ও বাম দিকের চল্লিশ বাড়ি পর্যন্ত প্রতিবেশী হিসেবে বিবেচিত হয়। আবার অন্যভাবে বলা যায় যে, আত্মীয় সম্পর্কিত না হওয়া সত্ত্বেও যারা আমাদের পাশাপাশি বাড়িতে কাছাকাছি অবস্থান করে তাদের প্রতিবেশী বলে।
প্রতিবেশীর বৈশিষ্ট্য: প্রতিবেশীর মধ্যে অনেক বৈচিত্র্য থাকে। গ্রামীণ জীবনে মানুষ স্থায়ীভাবে পাশাপাশি বাস করে। বংশানুক্রমে বসবাসের ফলে মানুষের মধ্যে একান্ত আত্মীয় পরিজনের সম্পর্ক গড়ে উঠে। অনাত্মীয় লোকজনের সঙ্গেও পাশাপাশি প্রতিবেশী হিসেবে বাস করার ফলে আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরি হয়। কিন্তু শহরাঞ্চলের প্রতিবেশী দুই ধরণের হয়। শহরের বাড়িতে ভাড়াটে হিসেবে অনেকে অস্থায়ীভাবে বসবাস করে। তাদের অস্থায়ী প্রতিবেশী হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। মানুষের জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে হলে অন্যের সাহায্য সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। আর প্রাথমিকভাবে এই সাহায্য সহযোগিতা মানুষ প্রতিবেশীর নিকট থেকেই পেয়ে থাকে।
প্রতিবেশীর ধরন: প্রতিবেশী হিসেবে যারা পাশাপাশি অবস্থান করে তাদের সকলের ধরণ এক রকম না হওয়াটাই স্বাভাবিক। প্রতিবেশীদের মধ্যে নানা ধরণের লোক থাকে। প্রতিবেশী হিসেবে যেমন ধনী লোক আছে তেমনি গরীব লোকও আছে। আবার এক দিকে যেমন শিক্ষিত লোক আছে তেমনি অশিক্ষিত লোকেরও অভাব নেই। কেউ বিশাল বাড়িতে বাস করে, কেউ সামান্য কুঁড়ের ঘরে দিন কাটায়। এভাবে বিচিত্র মানুষ নিয়েই প্রতিবেশীর অবস্থান। পেশাগত দিক দিয়েও প্রতিবেশীদের মধ্যে বৈচিত্র্য দেখা যায়। তাদের মধ্যে নানা ধরণের বৈচিত্র্য থাকলেও এক দিকে তাদের মিল রয়েছে তা হলো তারা পরস্পরের প্রতিবেশী। বাইরের সম্পর্ক যাই হোক না কেনো তাদের প্রতিবেশী সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তারা প্রতিনিয়ত দেখা হলে সৌজন্য প্রকাশ করে, খোঁজ-খবর নেয় এবং আপদে-বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।
প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য: প্রতিটি মানুষই তার প্রতিবেশীর প্রতি অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। কারণ সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ তার প্রতিবেশীর সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমেই জীবনযাপন করে। মানুষ সব দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। তাই জীবন যাপনের জন্য প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়। আর প্রতিবেশীদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হলে অনেক দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করতে হয়।

পারস্পরিক সহযোগিতা: পারস্পরিক সহযোগিতার উপর ভিত্তি করেই মূলত প্রতিবেশী সম্পর্ক টিকে থাকে। জীবনের নানা প্রতিকূলতায় প্রথম প্রতিবেশী খবর পায় এবং সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। এভাবে পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতায় প্রতিবেশীদের মধ্যে এক ধরণের মধুর সম্পর্ক তৈরি করে। তাই জীবন যুদ্ধে টিকে থাকতে হলে প্রতিবশীর নিকট থেকে যেমন সহযেগিতা দরকার তেমনি তাদের আপদ-বিপদেও এগিয়ে যাওয়া একান্ত প্রয়োজন।
প্রতিবেশীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা: পৃথিবীতে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার মধ্যে কোনো সার্থকতা নেই। এতে মানুষের মনুষ্যত্ব লোপ পায়। তাই জীবনকে সার্থকভাবে গড়ে তুলতে হলে সমাজের প্রতিটি মানুষকে নিয়ে ভাবতে হবে। প্রতিবেশীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে। তাদের আপদে-বিপদে, সুখে-দুঃখে, অভাব-অনটনে খোঁজখবর নিতে হবে। যারা বিত্তবান তাদের কাজ হলো গরীব প্রতিবেশীদের অভাব-অনটন দূর করা। তাদের জীবনের স্বাচ্ছন্দ্যের বিধান করা। এভাবে আমরা সকলেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রতিবেশীর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে তাদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করে পারস্পরিক সম্পর্ককে আরো দৃঢ় করতে পারি।
প্রতিবেশীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা: সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে নিরাপত্তার প্রয়োজন। নিরাপত্তার অভাবে মানুষের জীবন সবসময় ভয়-ভীতির মধ্যে কাটে। এর ফলে শুধু সমাজে বসবাসরত প্রতিবেশীই নয়, জাতীয় জীবনেও নানা রকম সমস্যা দেখা দেয়। তাই এক প্রতিবেশীর অন্য প্রতিবেশীর জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। প্রতিবেশী যাতে নিরাপদে এবং নিশ্চিতভাবে বসবাস করতে পারে সেদিকে আমাদের সবারই নজর দিতে হবে। তাহলে প্রতিবেশীদের আচার ব্যবহার জীবন যাত্রার মান উন্নত হবে। দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা বিরাজ করবে।

সদ্ব্যবহার ও সুসম্পর্ক: প্রতিবেশীরা আমাদের নিত্য দিনের সঙ্গী। প্রতিটি দিনই তাদের সাথে কোনো না কোনোভাবে দেখা সাক্ষাৎ হয়। আর প্রতিবেশীদের সাথে দেখা হলে সদ্ব্যবহার করা উচিত। সদ্ব্যবহারে প্রতিবেশীরা শান্তি পায়। আবার প্রতিবেশীদের সাথে কখনো ঝগড়া-ফ্যাসাদ করা উচিত নয়। তাদের সাথে সব সময় সুসম্পর্ক বজায় রাখা উচিত।

সহানুভূতিশীলতা: আমাদের সমাজে এমনক কিছু লোক আছে যারা প্রতিবেশীদের নিয়ে ভাবার সময় পায় না। আবার কিছু লোক আছে সময় পেলেও প্রতিবেশী সম্পর্কে উদাসীন থাকে। তারা সব সময় নিজেদের সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার চেষ্টায় নিয়োজিত থাকে। এ শ্রেণির লোকেরা পারলে প্রতিবেশীদের ঠকানোর চেষ্টা করে। যদিও এরা সমাজের উচ্চপদে অসীন থাকে এবং লোক দেখানো সম্মান পায় কিন্তু প্রতিবেশীদের কোনো প্রকৃত সম্মান পায় না। তাই প্রতিবেশীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়।
মহৎ ব্যক্তিগণের সহানুভূতিশীলতা: পৃথিবীর সকল ধর্মের মহৎ ব্যক্তিগণ প্রতিবেশীর প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। হযরত মুহাম্মদ (স.), গৌতম বুদ্ধ, স্বামী বিবেকানন্দ ও যিশু খ্রিস্ট এরা সবাই প্রতিবেশীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহানুভূতিশীল ছিলেন। প্রতিবেশী সম্পর্কে হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন- “আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তি উত্তম যে তার নিজ প্রতিবেশীর নিকট উত্তম।” মহৎ ব্যক্তিরা শুধু প্রতিবেশীদের প্রতি সহানুভূতিশীলই ছিলেন না বরং প্রতিবেশীদের অত্যাচারে জর্জরিত হয়েও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি। এভাবে তারা প্রেম, ভালোবাসা, ধৈর্য ও আদর্শ দিয়ে প্রতিবেশীদের মন জয় করেছিলেন।
প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্কের সুফল: প্রতিবেশীদের প্রতি যথাযথ কর্তব্য পালন করলে তাদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে এবং তা জীবনযাপনের জন্য বিশেষ সহায়ক হয়ে উঠে। প্রতিবেশী ভালো হলে আপদে-বিপদে সাহায্য এবং নিরাপদে নিশ্চিতে বসবাস করা যায়। আর প্রতিবেশী খারাপ হলে অশান্তির শেষ থাকে না। কিন্তু প্রতিবেশীদের সাথে সু-সম্পর্ক এক দিক থেকে হয় না। পারপস্পরিক আচার-আচরণের মধ্যে দিয়ে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাই আমাদের প্রত্যেকেরই প্রতিবেশীদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন।
উপসংহার: প্রতিবেশীদের সাথে সুসম্পর্ক থাকলে আত্মীয়ের চেয়েও গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সামাজিক জীবনে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা মানুষ প্রতিবেশীর নিকট থেকে পেয়ে থাকে। সে জন্য আমাদের ধনী-গরীব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ভালো-মন্দ সকল রকম প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন। তাহলেই পরস্পরের মঙ্গল সাধিত হবে। এ প্রসঙ্গে কামিনী রায় তাঁর পরার্থে কবিতায় বলেন- “সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।”





শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৯

জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা বাংলা রচনা



ভূমিকা: আধুনিক বিশ্বের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা বিষয় দুটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার যুগে বর্তমান বিশ্ব একটি বৈশ্বিক গ্রামে পরিণত হয়েছে। কোনো একটি দেশের উন্নয়ন এবং রাষ্ট্রীয় অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধান বহুলাংশে অন্য একটি দেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। একটি দেশের সাথে অন্যদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়নে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকবোধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ কী: জাতীয়তাবাদ (Nationalism) হলো নিজেকে কোনো জাতির অন্তর্ভুক্ত জ্ঞান করা। সেই জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, বিকাশ, অগ্রগতি, ভৌগোলিক অবস্থান, আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক মুক্তির আকাক্সক্ষা ইত্যাদির সাথে একাত্মবোধ করা এবং সংশ্লিষ্ট জাতির ঐতিহ্য, মূল্যবোধ, স্বকীয়তা রক্ষা ও বিকাশে বিশ্বাসী হওয়া। অপরদিকে আন্তর্জাতিকতাবাদ (Internationalism) হলো এমন একটি ধারণা বা মতবাদ যে ধারণা বিভিন্ন রাষ্ট্র বা জাতিকে একই বা বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সহযোগিতা বৃদ্ধি করে। জাতীয়তাবাদ যেমনভাবে একটি দেশের মধ্যে দেশের অভ্যন্তরীণ জাতীয় ঐক্য বজায় রাখার কথা বলে, তেমনি আন্তর্জাতিকতাবাদ দেশের বাইরে বিশ্বের বিভিন্ন স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কথা বলে।
জাতীয়তাবাদের প্রকাশ: আধুনিক বিশ্বের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সঙ্গে জাতীয়তাবাদ অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। বর্তমান বিশ্বে প্রত্যেক রাষ্ট্রকেই জাতীয় রাষ্ট্র বলা হয়। কোনো দেশের জনগণ যখন নিজস্ব ঐতিহ্য শিক্ষা-সভ্যতা, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও সাংস্কৃতিক চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয় তখনই তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের প্রকাশ ঘটে। জাতীয় চেতনায় বলীয়ান জাতি পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়। সকল দেশের জাতীয়তার ধরণ এক নয়। প্রত্যেকটি জাতির মধ্যে জাতীয়তাবোধের একেক দিক বিশেষরূপে প্রকাশ পায়।

জাতীয়তাবাদের উদ্ভব: প্রাচীন যুগে গ্রিক ও হিব্রুদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের ধারণা প্রথম দেখা যায়। গ্রিসের নগর রাষ্ট্রগুলো বিধ্বস্ত হওয়ার পর রোমানদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সমগ্র মধ্যযুগব্যাপী খ্রিস্টধর্মের প্রভাবে যখন দেশ পরিচালিত হয় তখন জাতীয়তাবাদ পুরোপুরি বিলীন হয়। এর পরিবর্তে সম্রাজ্যের ধারণা জন্মলাভ করে। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে জাতীয়তাবাদ নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়, যখন ল্যাটিন ভাষার আধিপত্যের বিপরীতে বিভিন্ন দেশে মাতৃভাষার ব্যবহার বাড়তে থাকে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিশ্বব্যাপী জাতীয়তাবাদ ধারণাটি দৃঢ় হয়। ১৭৭২ সালে পোলান্ডের ভাগাভাগির সময়ে জাতীয়তাবাদী চেতনা জনসাধারণের মধ্যে প্রসার লাভ করে। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের স্লোগানঃ ‘সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা’ জাতীয়তাবাদকে আরো জোরদার করে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিক এবং বিংশ শতাব্দী জাতীয়তাবাদের গৌরবোজ্জ্বল যুগ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে ১৯১৯ সালে ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। একই সালে জাতীয় রাষ্ট্রের ওপর ভিত্তি করে ইউরোপের মানচিত্র নতুন করে আঁকা হলে চেক, পোল, স্লাভ জাতিগুলো নতুন রাষ্ট্র গঠনের সুযোগ পায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং দূরপ্রাচ্যে জাতীয়তার ভিত্তিতে অনেকগুলো জাতীয় রাষ্ট্রের জন্ম হয়।

জাতীয়তাবাদ চেতনার গুরুত্ব: জাতীয় চেতনা কোনো দেশ বা জাতির উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতার পথে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। একটি জাতি তার স্বতন্ত্র সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য লালন করেই প্রথমে জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পরবর্তীতে সে জাতি অগ্রসর হয় আন্তর্জাতিকতার দিকে। জাতীয়তাবাদ আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে একটি সংঘবদ্ধ জনগোষ্ঠীর সার্বভৌম ক্ষমতার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। জাতীয় চেতনার ফলেই ব্যক্তির মধ্যে দেশপ্রেম এবং দেশাত্মবোধ জাগ্রত হয়।
আন্তর্জাতিকতাবাদ চেতনার সৃষ্টি: আন্তর্জাতিকতা বলতে আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ককে বুঝি। বর্তমান যুগে বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে বিজ্ঞানের প্রসার লাভ করছে। অনেক দেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক উন্নত হচ্ছে। কিছু দেশ আবার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে অনেক সমৃদ্ধ। আধুনিক বিশ্ব প্রতিযোগিতার বিশ্ব, এখানে কোনো রাষ্ট্র কোনা দিক থেকে পিছিয়ে থাকতে চায় না। তাই তারা সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য বাধ্য হচ্ছে। এক দেশের মানুষ এখন সহজেই অন্য দেশে গমন করতে পারছে, তথ্য আদান প্রদান করতে পারছে। মানুষ সমগ্র পৃথিবীকে নিজেদের মনে করছে। আর এভাবেই আন্তর্জাতিক চেতনার সৃষ্টি হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক চেতনার গুরুত্ব: বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে আন্তর্জাতিক চেতনার গুরুত্ব অপরিসীম। দেশ ও জাতির প্রতি অবদান রাখার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ এখন নিজ নিজ দেশের সীমানা পেরিয়ে উচ্চ শিক্ষা এবং গবেষণার জন্য অন্যদেশে পাড়ি জামাচ্ছে। বর্তমান পৃথিবীতে ১৯৪টি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ রয়েছে। তারা নিজেদের প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক চেতনায় ভর করে সম্পর্ক স্থাপন করে চলছে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ভৌগোলিক প্রয়োজনে বা কখনো কখনো ধর্ম, ভাষা, গোত্রগত দৃষ্টিভঙ্গি ও বিভিন্ন দেশের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এটি ভূমিকা রাখে। বিশ্বের বিভিন্ন জাতিসমূহের মধ্যে বন্ধুত্বের মনোভাব গড়ে তুলতে, বিরাজমান নানা সমস্যা ও সংকট দূরীকরণে, অগ্রগতি ও মঙ্গল নিশ্চিতকরণ, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়গুলোতে পারস্পরিক আদান-প্রদান ও সার্বিক সহযোগিতা আন্তর্জাতিক চেতনার উপর নির্ভর করে।
উগ্র-জাতীয়তাবাদের কুফল: জাতীয়তাবাদ যেমন মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে তেমনি উগ্র-জাতীয়তাবাদ অনেক ক্ষেত্রে কোনো দেশের জনগণকে মাত্রাতিরিক্ত অহঙ্কারী করে তোলে। এ জন্য তারা অন্য দেশের প্রতি বৈরী মনোভাব দেখায়, সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়। অনেক সময় নিজেদেরকে অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর জাতি মনে করে। উগ্র-জাতীয়তাবাদের প্রভাবে তারা অন্য দেশের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির নাৎসিদের মধ্যে উগ্র জাতীয়তবাদের প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়া ইউরোপ ও আমেরিকাতে এ রকম ধারণা প্রচলিত ছিল।
আন্তর্জাতিকতাবাদের ফলে গঠিত সংগঠন:আন্তর্জাতিকতাবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে গড়ে উঠেছে পারস্পরিক সহযোগিতামূলক সংগঠন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘ (United Nations) গঠিত হয়। বর্তমানে ১৯৩টি দেশ এই সংগঠনটিতে কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে বাণিজ্যের প্রসারের লক্ষ্যে ১৯৯৫ সালের ১ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (WTO)। বৃটেন শাসিত দেশ নিয়ে গড়ে উঠেছে কমনওয়েলথের মতো আন্তর্জাতিক সংগঠন। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার জন্য ১৯৬৯ সালের ২৫ সেপ্টে¤¦র গড়ে উঠেছে ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (OIC), এ ছাড়া NAM, IMF ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সংগঠন সফলতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।আন্তর্জাতিকতার ফলে গড়ে উঠেছে অনেক আঞ্চলিক সংগঠন। ASEAN(এশিয়ান) ভুক্ত দেশ সমূহের মধ্যে সহযোগিতার ফলে ঈর্ষনীয় উন্নতি লাভে সক্ষম হয়েছে। পৃথিবীব্যাপী রাজনৈতিক সহযোগিতার ফলে গড়ে উঠেছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (EU), আফ্রিকান ইউনিয়ন , আরব লীগ ইত্যাদি। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক জোট হিসেবে G-8 (Group 08), D-8 (Developing-8), G-77, OPEC, APEC ইত্যাদি সংগঠন গঠিত হয়েছে। এছাড়াও সামরিক, আর্থিক, সেবা, মানবাধিকার সংস্থা হিসেবে ন্যাটো (NATO), IDB, ADB, NAFTA, APTA, রোটারি ইন্টারন্যাশনাল, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইত্যাদি সংগঠন আন্তর্জাতিকতার ভিত্তিতেই কাজ করে যাচ্ছে।
জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতায় বাংলাদেশ: ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতার পর থেকে বাঙালি জাতীয়তার ওপর ভিত্তি করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ইত্যাদির সমন্বয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ধারণ করে বাংলাদেশের মানুষ দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জায়গা করে নিয়েছে। স্বাধীনতার পর পরই ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে যোগদান করেছে। এরপর ১৯৮৫ সালের ৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভূটান, শ্রীলংকা ও মালদ্বীপ এই ৭টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত হয় দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (SAARC)। বর্তমানে আফগানিস্তানসহ ৮টি দেশ নিয়ে এ সংস্থাটি কাজ করে যাচ্ছে। এ ছাড়াও বাংলাদেশ বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, ADB, বিশ্বব্যাংক ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সংগঠনের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।

উপসংহার: পারস্পরিক সহযোগিতা ব্যতীত আজকের বিশ্বে উন্নয়ন অসম্ভব। সকল দেশের উচিত নিজ নিজ জাতিগত দম্ভ ভুলে বিশ্বের শান্তি ও উন্নয়নের লক্ষ্যে পরস্পরের প্রতি সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা। তবেই দেশের অভ্যন্তরীণ উন্নতির পাশাপাশি বৈশ্বিক উন্নয়ন সম্ভব হয়ে উঠবে।


শুক্রবার, ৪ অক্টোবর, ২০১৯

পরিবেশ দূষণ বাংলা রচনা





ভূমিকা: লাখ লাখ বছর আগে পৃথিবীর বুকে যে প্রাণ ও প্রাণীর সৃষ্টি হয়েছিল সেদিন প্রকৃতি ও পরিবেশে সাম্য ছিল। এ ভারসাম্য বজায় রাখতে ভূমিকা ছিল প্রকৃতি ও পরিবেশের। সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের পথ ধরেই মানুষ একটু একটু করে গড়ে তুলেছে নিজের পরিবেশ। মানুষের রচিত পরিবেশ তারই সভ্যতার বিবর্তন ফসল। মানুষ তার নতুন নতুন আবিষ্কারের প্রতিভা, পরিশ্রম আর দক্ষতা দিয়ে সংগ্রহ করেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন পদ্ধতি। অধিগত করেছে জীবন-বিকাশের নানা উপকরণ। তাই দিয়ে সে তার নিজের প্রয়োজন ও রুচি অনুযায়ী তৈরি করেছে তার পরিবেশ। এ পরিবেশের মধ্যেই তার বিকাশ, তার বিনাশের ইঙ্গিত।

পরিবেশ দূষণের কারণ: জনসংখ্যা বৃদ্ধি পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে প্রাকৃতিক সম্পদ জল, মাটি, বায়ুর ওপর পড়েছে প্রচণ্ড চাপ। শুরু হয়েছে বন সম্পদ বিনষ্টের অমিত উল্লাস। একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উদ্ভিদ জগৎ ও প্রাণী জগৎ। প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য এসে পৌঁছেছে এক সংকটজনক অবস্থায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ক্রমবর্ধমান হারে শক্তি উৎপাদনের চাহিদা। শক্তি উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে নির্গত হয় মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ-দূষক নানা রাসায়নিক দ্রব্য। দূষিত রাসায়নিক দ্রব্যই নানা দুরারোগ্য ব্যাধির দ্রুত প্রসারণের কারণ। এতে বায়ু-জল-খাদ্যদ্রব্য মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে।

বায়ু দূষণ ও নানা প্রতিক্রিয়া: দূষণের প্রকৃতি ও পদ্ধতির মধ্যেও রয়েছে বিভিন্নতা। আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের অন্যতম উপকরণ হলো বায়ু। সেই বায়ু দূষণ আজ বিশ্বজুড়ে। সবার স্বাস্থ্যের পক্ষেও এ এক গুরুতর সমস্যা। বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ নিয়ত বাড়ছে। ফলে আবহাওয়ায় তাপমাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। অকাল-বর্ষণ, ঝড়জল, কুয়াশা এরই ফল। এ রকম আবহাওয়ায় চাষবাস হয় অনিশ্চিত। কুয়াশা আর তেল, কয়লা দহনের ফলে নির্গত গ্যাসের মিশ্রণে ধোঁয়াশার সৃষ্টি। তার ক্ষতিকারক ক্ষমতা মারাত্মক। মাথাধরা, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, দীর্ঘস্থায়ী ব্রংকাইটিস, ফুসফুস-ক্যানসার এ জাতীয় দূষণের ফল। বিভিন্ন যানবাহনের নির্গত ধোঁয়া সূর্যের আলোর সংস্পর্শে এসে তৈরি করে আলোক রাসায়নিক ধোঁয়াশা। অক্সাইড ও
পানি দূষণ: পানি দূষণ আধুনিক সভ্যতার আরেক অভিশাপ। পৃথিবীর সমুদ্র, নদ-নদী, পুকুর, খালবিল ইত্যাদির পানি নানাভাবে দূষিত হচ্ছে। নদীর তীরে গড়ে উঠেছে সমৃদ্ধ জনপদ, শহর। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আধুনিক চটকল, কাপড়কল, কয়লা ধোলাইকল, চিনিকল, কাগজের কল, ভেষজ তেল তৈরির কারখানা, চামড়া পাকা করার কারখানা ইত্যাদি। এসব কলকারখানার আবর্জনা প্রতিনিয়ত নদ-নদীর পানি দূষিত করছে। প্রতি দিন বিভিন্ন শিল্পাঞ্চল থেকে ক্ষার, অ্যামোনিয়া, সায়ানাইড, ন্যাপথালিন, ফিনল ও বিবিধ রাসায়নিক জল দূষক উপাদান এসে মিশছে। দূষণের কবলে বাংলাদেশের প্রায় সব নদীর পানি। পুকুর, খাল-বিল দূষণের জন্য নালা-নর্দমা, ঘরবাড়ির আবর্জনা ইত্যাদি দায়ী। এর থেকেই দূষিত হয় মাটি, দূষিত হয় পানীয় জল। সমুদ্র নদী খালবিল পুকুরের মাছেও নানারূপ দূষণ ঘটছে। ছড়িয়ে পড়ছে নানা রকমের সংক্রামক রোগ। মাঝেমধ্যে তা মহামারির আকার ধারণ করে। মৃত্যু এসে ছিনিয়ে নিয়ে যায় কত জীবন। এমনি করেই দিনের পর দিন জনস্বাস্থ্য বিনষ্ট হচ্ছে।

শব্দ দূষণ: শব্দ দূষণ এ যুগের এক গুরুত্বপূর্ণ, জলজ্যান্ত সমস্যা। দিন দিন এ সমস্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। শহরে শব্দ দূষণের মাত্রা সর্বাধিক। প্রতিনিয়তই এখানে মোটরগাড়ির হর্ন, কলকারখানার বিকট আওয়াজ, বাজি পটকার শব্দ, রেডিও, টেলিভিশনের শব্দ, লোকজনের চিৎকার চেঁচামেচি, উৎসবের মত্ততা, মাইকে চড়া সুর, সব মিলেমিশে এক অপস্বর সৃষ্টির মহাযজ্ঞ চলছে। শব্দ দূষণের পরিণাম ভয়াবহ।শব্দ দূষণের উৎস অনেক এবং অনেক ধরনের। যথাযথ কারণ ছাড়া যত্রতত্র মাইক বা ক্যাসেট প্লেয়ার বাজানো বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে হর্ন বাজানো এবং হাইড্রোলিক হর্ন বাজানো আইনগতভাবে বন্ধ করতে হবে। আবাসিক এলাকায় যাতে কলকারখানা গড়ে উঠতে না পারে, তার ব্যবস্থা করতে হবে।বন ও পরিবেশ আইন ১৯৯৭ অনুসারে হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে ১০০ মিটার পর্যন্ত এলাকাকে নীরব এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। শব্দ দূষণ রোধে মানুষের সচেতনতা সবচেয়ে বেশি।ঢাকা এখন শব্দ দূষণের নগর। ২০০৩ সালে দুই স্ট্রোকবিশিষ্ট অটোরিকশা ঢাকা শহর থেকে উঠিয়ে দেওয়ার পর বায়ু দূষণের পাশাপাশি শব্দ দূষণের মাত্রাও অপেক্ষাকৃত কমে যায়, ফলে নগরবাসী কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিল। কিন্তু তাদের সে স্বস্তি বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। শব্দ দূষণের ফলে যে অসুখ হয়, তার মেয়াদ দীর্ঘমেয়াদি হয় বলে মানুষ তৎক্ষণাৎ এর কুফল বুঝতে পারে না। তাই এদিকে মানুষের নজরও থাকে কম। এ কারণে ঢাকার আবাসিক এলাকা, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—কোনো কিছুই রেহাই পাচ্ছে না যানবাহনের হাইড্রোলিক হর্ন, কারখানার উচ্চশব্দ, মাইক ও সিডি প্লেয়ারের উদ্দাম আওয়াজ থেকে।

শব্দ দূষণের ভয়াবহতা: শব্দ দূষণ যে শুধু বিরক্তি সৃষ্টি করে তাই নয়, মানবদেহের আর্টারিগুলো বন্ধ করে দেয়, এড্রনালিনের চলাচল বৃদ্ধি করে এবং হূৎপিণ্ডকে দ্রুত কাজ করতে বাধ্য করে। ধারাবাহিক উচ্চ শব্দের মধ্যে থাকলে হার্টঅ্যাটাক ও স্ট্রোকের আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, শব্দ দূষণ স্নায়বিক বৈকল্যের কারণ হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ধারাবাহিক শব্দ দূষণ শ্রবণশক্তি নষ্ট করে এবং স্নায়ুর স্থায়ী ক্ষতি সাধন করে। তাঁদের মতে, রাজধানীতে বসবাসকারী মানুষের হার্ট, কিডনি ও ব্রেনের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ছে। শব্দ দূষণে শিশুদের মেজাজ হচ্ছে খিটখিটে। তারা শ্রবণশক্তি হারাচ্ছে, হারাচ্ছে তাদের একনিষ্ঠতা। এর প্রভাব তাদের লেখাপড়ার ওপর পড়ছে। সব ধরনের শব্দ দূষণের ফলেই মানুষের ঘুম, শ্রবণশক্তি, মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। যেকোনো ধরনের শব্দ দূষণই গর্ভবতী মায়েদের ক্ষতি করে দারুণভাবে। শব্দ দূষণে মানুষের স্থায়ী মানসিক বৈকল্য দেখা দিতে পারে।

তেজস্ক্রিয় দূষণ: পারমাণবিক যুদ্ধ, পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে তেজস্ক্রিয় দূষণের বিপদ সবচেয়ে বেশি নিহিত। ১৯৬৩ তে একটি মার্কিন নিউক্লিয় সাবমেরিন আটলান্টিক সাগরে হারিয়ে যায়। তা থেকে প্রচুর পরিমাণে তেজস্ক্রিয় পদার্থ ছড়িয়ে পড়ে প্রাকৃতিক পরিবেশে। নিউক্লিয় জ্বালানি উৎপাদনকেন্দ্রের আবর্জনা তার ক্ষতিকারক ক্ষমতা নিয়ে ৬০০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে।

দূষণের প্রতিকার: দূষণের ভয়াবহ পরিণামের কথা ভেবে বিশ্বের সভ্য মানুষ আজ আতঙ্কিত। কী উপায়ে এ ভয়ংকর সমস্যার মোকাবিলা সম্ভব তা নিয়ে ভাবনা, পরিকল্পনার শেষ নেই। বায়ু দূষণের প্রতিকারের জন্য গ্রহণ করা হয়েছে কলকারখানার দহন-প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে নির্গত দূষকের পরিমাণ কমানোর ব্যবস্থা। তা ছাড়া গ্রহণ করা হয়েছে বৃক্ষ রোপণ পরিকল্পনা। এক গবেষণায় দেখা গেছে, একমাত্র বনায়নের মাধ্যমেই প্রায় সব ধরনের পরিবেশ দূষণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। দূষিত পানিকে পানযোগ্য করে তুলতে হলে উপযুক্ত পরিস্রবণ দরকার। শব্দ দূষণের কুপ্রভাব কমানোর প্রধান উপায় হলো, শব্দবিরোধী কক্ষের ব্যবহার। প্রযুক্তিবিদ্যার সাম্প্রতিক অগ্রগতিতে এমন কতকগুলো পদ্ধতির উদ্ভাবন হয়েছে, যাতে পরমাণু চুল্লির আবর্জনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়েছে। এর ফলে নিউক্লিয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিবেশে কোনো তেজস্ক্রিয় থাকবে না।

উপসংহার: পরিবেশ দূষণ সমস্যা নিয়ে আজ সব দেশই চিন্তিত। সভ্যতার অস্তিত্বই আজ এক সংকটের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। তাই ১৯৭২ সালে ‘মানুষের পরিবেশ’ নিয়ে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের অধিবেশন হয়ে গেল স্টকহোমে। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিওডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত হয়েছে ১২ দিনব্যাপী ধরিত্রী সম্মেলন। বাংলাদেশের সংবিধানেও পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধের শর্ত আরোপ করা হয়েছে। এখানেও প্রতি বছর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হচ্ছে। আজ পরিবেশ দূষণ মানব সভ্যতার জন্য ভয়ংকর বিপদের পূর্বাভাস। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ পৃথিবী গড়ে তোলার লক্ষ্যে যেকোনো মূল্যে পরিবেশ দূষণ রোধ করার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।





সমাজসেবা বাংলা রচনা





ভূমিকা: মানুষ যেদিন থেকে গুহাবাস ছেড়ে সমাজবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল জীব হিসেবে বসবাস করতে অভ্যস্ত হলো, সেদিন থেকে এক বৃহত্তর মঙ্গল কামনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার অঙ্গীকার গ্রহণ করলো। মানুষ আজ সভ্যতার চরম শিখরে আরোহন করছে। আর এটা মানুষের একক প্রচেষ্টায় সম্ভব হয়নি বরং যুগ যুগান্তর ধরে চলে আসা মানব সম্প্রদায়ের বৃহত্তর স্বার্থ অর্জনের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। সমাজজীবন মাত্রই সহযোগিতা, সহিষ্ণুতা, মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ ও প্রতিফলন। সমাজ সেবার মাধ্যমে একটি কর্মমুখর, সচল ও উন্নত সমাজ গঠন করা সম্ভব। সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর মধ্যেই জীবনের যথার্থ সার্থকতা নিহিত। অপরের কল্যাণ কামনাকে প্রাধান্য দিয়ে নিজের স্বার্থকে ত্যাগ করার নামই সমাজসেবা।

সমাজসেবার বৈশিষ্ট্য: প্রখ্যাত কবি কামিনী রায় তাঁর ‘পরার্থে’ কবিতায় যথার্থই উল্লেখ করেছেন-

‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবনী পরে,
সকলের তরে সকলে আমরা
প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।’সমাজে একসাথে বাস করতে গেলে কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য ব্যক্তির উপর আপনা আপনিই বর্তায়। প্রকৃত সামাজিক জীব হিসেবে প্রত্যেক মানুষের উচিত স্ব স্ব অবস্থান থেকে যথাসাধ্যভাবে এসব দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো পালন করা। বৃহত্তর জনগোষ্ঠির কল্যাণ কামনাই সমাজ সেবা। যে বিশ্বমানব গোষ্ঠির জন্য নিজেকে নিবেদিত রাখে সেই প্রকৃত মহৎ হৃয়ের মানুষ। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন- ‘আপনা রাখিলে ব্যর্থ জীবন সাধনা/জনম বিশ্বের তরে পরার্থে কামনা।’ পাশ্চাত্য মনীষী Ruskinবলেন- “There are three kinds of duties; duties towards God, duties towards Parents and duties towards mankind.”

সমাজ সেবার ধর্মীয় মূল্যবোধ: বিভিন্ন ধর্মে সমাজ সেবাকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়েছে। বিশ্বনবী হযরত মুহম্মদ (স.) বলেছেন- ‘মানুষের মধ্যে তিনিই শ্রেষ্ঠ যিনি মানুষের উপকার করেন। মানব সেবা সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ বলে গেছেন- ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’। মানবতার কল্যাণ সাধনের মহান ব্রতে উদ্বুদ্ধ হয়ে মহাপুরুষ বুদ্ধদেব সংসার জীবন, সুখ-ঐশ্বর্য ও সাম্রাজ্য সব কিছুর সাথে যোগাযোগ ছিন্ন করে পথে বের হয়েছিলেন। বিভিন্ন ধর্ম শাস্ত্র-, প্রবিত্র কুরআনে, রামায়ন-মহাভারতে, মহাকাব্যে, পুরাণে সমাজ সেবা তথা জনসেবাকেই শ্রেষ্ঠ ধর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।

সমাজ সেবার গুরুত্ব: পারস্য কবি শেখ সাদী বলে গেছেন-

সেজদা ও তসবিহ দেখে, খোদ এলাহি ভুলবে না
মানবসেবার কুঞ্জি ছাড়া স্বর্গদ্বার খুলবে না’সুতরাং একথা অকপটে বলা যায় যে, ইহলৌকিক ও পরলৌকিক মুক্তির পথ নিশ্চিত করতে সমাজ সেবার গুরুত্ব অপরিসীম। মানবতার সেবা তথা সমাজসেবার মাধ্যমেই জীবনের প্রকৃত আত্মতৃপ্তি লাভ করা যায়। সমাজসেবার মহান ব্রতে সবাই একতাবদ্ধভাবে এগিয়ে আসলে সমাজের রূপই পাল্টে যায়, যার প্রভাব উন্নত দেশ ও জাতি গঠনে ব্যাপক কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। অন্যের কল্যাণ কামনায় নিয়োজিত করতে পারার মধ্যেই মানুষের জীবন সুখময় ও আনন্দময় হয়ে ওঠে। যে জাতি যতো সমৃদ্ধ ও উন্নত তাদের মধ্যে জাতীয় ঐক্য ও সমাজসেবার প্রবণতা ততো বেশি।

সমাজসেবার ধরণ ও পদ্ধতি: রজনীকান্ত সেন সমাজসেবার পরিচয় ও পদ্ধতি উল্লেখ করে বলেছেন:

‘অন্নহীনে অন্নদান, বস্ত্রহীনে বস্ত্রদান তৃষ্ণাতুরে জল দান,
ধর্ম ধর্মহীনে, মুর্খজনে বিদ্যাদান,
বিপন্নে আশ্রয়, রোগীর ঔষধ দান,
ভয়ার্তে অভয়, গৃহহীনে গৃহদান,
অন্ধেরে নয়ন, পীড়াতে আরোগ্যদান,
শোকার্তে সান্তনা, স্বার্থ শূণ্য হয়
যদি এ দ্বাদশ দান
স্বর্গের দেবতা নহে দাতার সমান’।সমাজে কেউ বিত্তবান, আবার কেউ অসহায়। যারা সম্পদশালী তারা আর্থিকভাবে সাহায্য দিয়ে সমাজের দীন-দুঃখীদেরকে সাহায্য করতে পারে। আর যাদের সে সামর্থ্য নেই, তারা সান্তনা দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে, অসুস্থকে সেবা দিয়ে, সাধ্যমতো শ্রম দিয়ে অপরের কল্যাণে নিজেকে নিবেদিত করতে পারে। সমাজসেবা করতে যখন বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের লোক একতাবদ্ধ হয় তখন সমাজে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে সঙ্গতি রেখে পাঠ কার্যক্রম পরিচালনা ও স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যথা-অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, বন্যা, ভূমিকম্প-এসবের সময় জনসাধারণের পাশে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে এবং পূর্ব থেকে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্ঠায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

রাজনৈতিক দল ও সমাজ সেবা: সমাজ সেবার সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর এক নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। সমাজসেবা করার এক অন্যতম মাধ্যম হতে পারে রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক দলগুলো জনবল, প্রশাসনিক ও আর্থিক সব দিক দিয়েই ক্ষমতাসম্পন্ন। তারা যদি ন্যায়-নিষ্ঠার সাথে এসব ক্ষমতাকে কাজে লাগায় তাহলে সমাজে মানুষ উপকৃত হবে। আর তারা যেহেতু জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হন সেহেতু জনগণের কল্যাণসাধনা তাদের ক্ষমতা অর্জনের প্রধান ব্রত হওয়া উচিত। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ প্রতিশ্রুতিমূলক কথাবার্তা আর আশার আলো দেখিয়ে ক্ষমতা অর্জন এবং অধীকৃত ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার দিকেই তাদের প্রাণান্ত প্রচেষ্ঠা।

সমাজসেবার নিয়মিত চর্চা: সভা-সমাবেশ, সিম্পোজিয়াম, পোস্টার ছাপানোসহ বিভিন্নভাবে জনমনে সমাজসেবা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সমাজ সেবা প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা একটি প্রথা। যুগের বিবর্তনে সমাজ ক্রমশ বিকাশ ও উন্নতি লাভ করছে। সমাজ সেবার প্রবণতা যদি প্রাচীন আমল থেকে প্রচলিত না থাকতো তাহলে বর্তমানে আমরা এমন সুসভ্য সমাজজীবন উপভোগ করতে পারতাম না।

মহান আদর্শ: সমাজসেবার ক্ষেত্রে বাংলার ক্ষুদিরাম, নূর হোসেন, হাজী মুহম্মদ মহসীন, শেরে বাংলা ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, আফ্রিকার বর্ণপ্রথা বিরোধী বিশ্বখ্যাত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, আর্জেন্টিনার চে গুয়েভার প্রমুখ মহান নেতার নাম উল্লেখযোগ্য। জনকল্যাণে আত্মনিয়োগ করার মাধ্যমেই ইতিহাসে তারা চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তারা শুধুমাত্র অর্থদিয়ে নয়, নিঃস্বার্থভাবে জীবন দিয়ে মানবকল্যাণে আত্মনিয়োগ করে গেছেন। এসব মহৎপ্রাণ ব্যক্তির জীবনাদর্শ অনুসরণ করে সমাজসেবায় আমরা নিজেদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে পারি।

আন্তর্জাতিক সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা:বিশ্বব্যাপী মানুষের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পৃথিবীর সবদেশে সমাজসেবার ধারণা জনপ্রিয়তা লাভ করছে। সামাজিক সুযোগ-সুবিধাগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে বিশ্বব্যাপী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান। এদের মধ্যে OIC, RED CRESENT SOCIETY, UNO, UNICEF, UNESCO প্রভৃতি সংস্থার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আমাদের দেশীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন এনজিও, রামকৃষ্ণ মিশন, বাঁধন ইত্যাদি।

উপসংহার: সমাজসেবায় মনুষ্যত্বের বিকাশ লাভ হয়। সমাজসেবার মাধ্যমে একজন অপর জনের কাছাকাছি আসতে পারে। ফলে সমাজে মানুষের সাথে মানুষের আত্মার বন্ধন গড়ে ওঠে। নিঃস্বার্থ সমাজসেবা মানুষের অনিন্দ্য সুন্দর গুণাবলির একটি। প্রত্যেক মানুষের উচিত নিজের ভিতরে লুকিয়ে থাকা হিংসা-বিদ্বেষ, কপটতা-ভন্ডমি, এসব কুপ্রবৃত্তিকে শক্ত হাতে দমন করে সমাজসেবার মহান আদর্শে নিজেকে পরিচালিত করা।