মঙ্গলবার, ২৯ আগস্ট, ২০২৩

জগদীশচন্দ্র বসু জীবনী মূলক রচনা



জগদীশচন্দ্র বসু পৃথিবী-বিখ্যাত এক বাঙালি বিজ্ঞানীর নাম। বাংলাদেশের অতিপ্রাচীন জনপদ বিক্রমপুরে তাঁর পৈতৃক নিবাস। জগদীশচন্দ্র বসুর বাবা ভগবানচন্দ্র বসু এবং মা বামাসুন্দরী দেবী।
ভগবানচন্দ্র বসু ছিলেন শিক্ষিত, অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন্ন, আধুনিক ও স্বাধীনচেতা একজন মানুষ। ভগবানচন্দ্র বসু প্রথম জীবনে স্কুলে শিক্ষকতা করেন ময়মনসিংহের একটি বাংলা স্কুলে। এ ময়মনসিংহেই জগদীশচন্দ্র বসুর জন্ম ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর। পরে ভগবানচন্দ্র বসু চাকরি নেন ব্রিটিশ সরকারের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে।
ব্রিটিশ সরকারের চাকুরে এ ব্যতিক্রমী মানুষটি চাইতেন ছেলে বড় হয়ে অন্যের গোলাম হবে না। তাই তিনি ছেলেকে দেশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে মেলামেশার অবারিত সুযোগ করে দেয়ার জন্য স্কুল জীবনের শুরুতেই ভর্তি করান একটি সাধারণ বাংলা মাধ্যমের স্কুলে।
গ্রামের বাংলা মাধ্যমের এ স্কুলের শিক্ষাই যে তাঁর জীবনের ভবিষ্যতের পাথেয় হয়েছিল, সে অভিজ্ঞতার কথা জগদীশ বলেন,

'শৈশবকালে পিতৃদেব আমাকে বাংলা স্কুলে প্রেরণ করেন। তখন সন্তানদিগকে ইংরেজি স্কুলে প্রেরণ আভিজাত্যের লক্ষণ বলিয়া গণ্য হইত। স্কুলের দক্ষিণ দিকে আমার পিতার মুসলমান চাপরাসীর পুত্র এবং বাম দিকে এক ধীবরপুত্র আমার সহচর ছিল। তাহাদের নিকট আমি পশুপক্ষী ও জীবজন্তুর বৃত্তান্ত স্তব্ধ হইয়া শুনিতাম। সম্ভবত প্রকৃতির কার্য অনুসন্ধানে আমার অনুরাগ এইসব ঘটনা হইতেই বদ্ধমূল হইয়াছিল।'
ছোটবেলায় জগদীশের নিত্যদিনের সহচর ছিল একজন ডাকাত সর্দার। বালক জগদীশ প্রতিদিন ওই ডাকাতের কাঁধে চড়ে স্কুলে যায়, আবার স্কুল ছুটির পর ডাকাতের কাঁধে চড়েই বাড়ি ফিরে আসে। ছেলেবেলায় এ ডাকাত সর্দারের কাছ থেকে জগদীশ শোনেন তাঁর যৌবনের অনেক গল্পকথা। ডাকাত সর্দারের অসীম সাহসিকতার কাহিনী শুনে রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে বালক জগদীশের মন।
ফরিদপুরের সাধারণ বাংলা স্কুলে ৫ বছর পড়ার পর ১০ বছর বয়সে জগদীশ চলে আসেন কলকাতায়। প্রথমে ভর্তি হন হেয়ার স্কুলে। পরে ভর্তি হন কলকাতার বিখ্যাত সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে। এ স্কুল থেকে ১৮৭৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করেন। এর পর তিনি ভর্তি হন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। এ কলেজেই শিক্ষাগুরু হিসেবে পেয়ে যান পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ফাদার লাফোঁকে। পদার্থবিজ্ঞানের দুরূহসব তত্ত্বকে খুব সহজে শিক্ষার্থীদের কাছে উপস্থাপন করাতে ফাদার লাফোঁর জুড়ি ছিল না। তাছাড়া নতুন শিক্ষার্থীদের পদার্থবিজ্ঞানে আগ্রহী করে গড়ে তুলতেও তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। জগদীশচন্দ্র ফাদার লাফোঁর সাহচর্যেই পদার্থবিজ্ঞানে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
১৮৭৭ সালে এ কলেজ থেকে এফএ পাস করেন এবং ১৮৮০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করেন।


১৮৮১ সালের জানুয়রি মাসে ক্যামব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজে প্রকৃতিবিজ্ঞানে ভর্তি হন জগদীশ। এ কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক লর্ড র‌্যালে, শারীরতত্ত্ববিদ মাইকেল ফস্টার, ভ্রূণতত্ত্ববিদ ফ্রান্সিস বালফুর, ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক হাগস, শারীরতত্ত্ববিদ ফ্রান্সিস ডারউইন, অধ্যাপক ভাইনসের মতো পৃথিবী-বিখ্যাত বিজ্ঞানীর সংস্পর্শে জগদীশ বিজ্ঞানে আরও অধিক উৎসাহী হয়ে ওঠেন।

১৮৮৪ সালে লন্ডনের পড়ালেখা শেষ করে জগদীশ দেশে ফিরে আসেন শিক্ষকতা পেশায় যোগদানের অভিপ্রায়ে। ১৮৮৫ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু এ পদে তাঁর বেতন নির্ধারণ করা হলো একজন ইউরোপীয় সহকারী অধ্যাপকের এক-তৃতীয়াংশ। সমযোগ্যতাসম্পন্ন একজন ভারতীয়ের বেতন একজন ইউরোপীয়র এক-তৃতীয়াংশ_ জগদীশের পক্ষে এ অন্যায় মেনে নেয়া ছিল অসম্ভব। খুব স্বাভাবিকভাবেই জগদীশ ব্রিটিশদের এ অপমানজনক নিবর্তনমূলক নিয়ম মেনে নেননি। প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠেন তিনি। বিনা বেতনে শিক্ষকতা শুরু করেন জগদীশ। দীর্ঘ ৩ বছর নিরবচ্ছিন্ন প্রতিবাদে অবশেষে পিছু হটতে বাধ্য হয় ব্রিটিশরা। ভারতীয়দের জন্য অমর্যাদাকর নিয়ম রহিত করে ১৮৮৮ সালে। তিন বছরের পাওনা একসঙ্গে পরিশোধ করে ব্রিটিশ সরকার।

প্রেসিডেন্সি কলেজে শিক্ষকতার পাশাপাশি জগদীশ পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা শুরু করেন। অল্পদিনেই তিনি সাফল্য পান। অতিক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যবিশিষ্ট আলোর ধর্ম এবং তা উৎপাদন ও ধরার যন্ত্র উদ্ভাবন করেন তিনি। ১৮৯৫ সালের ১ মে এশিয়াটিক সোসাইটির এক সম্মেলনে গবেষণা প্রবন্ধ পাঠ করেন তিনি। একই বছর কলকাতার টাউন হলে এক প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন। এ প্রদর্শনীতে তিনি তাঁর উদ্ভাবিত মাইক্রোওয়েভ দিয়ে লোহার গোলা নিক্ষেপ করেন, পিস্তলের আওয়াজ ফোটান এবং বারুদস্তূপ উড়িয়ে দিতে সক্ষম হন।
বলাবাহুল্য, জগদীশের এ প্রদর্শনীই বর্তমানের রাডার প্রযুক্তির প্রাথমিক ধাপ। জগদীশচন্দ্র বসু উদ্ভাবিত এ মাইক্রোওয়েভ দিয়ে বিনা তারে সংবাদ প্রেরণ করা সক্ষম ছিল। কিন্তু জগদীশ চেয়েছিলেন এ তরঙ্গের আরও বহুমুখী ব্যবহার।

১৮৯৬ সালের ২৪ জুলাই বোম্বে থেকে জাহাজে করে জগদীশ লন্ডনের উদ্দেশে রওনা করেন। ওই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর তিনি ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনের বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে বক্তৃতা প্রদান করেন। এদিন বক্তৃতাস্থলে উপস্থিত ছিলেন জেজে থমসন, অলিভার লজ, লর্ড কেলভিন প্রমুখ। এটি ছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর প্রথম বক্তৃতা।

জগদীশের এ বক্তৃতার মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানের রাজ্যে বাঙালির যাত্রা শুরু। জগদীশচন্দ্র বসুই প্রথম বাঙালি বিজ্ঞানী, যাঁর গবেষণা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশকে বিজ্ঞানের অঙ্গনে সুপরিচিত করে তোলে। বক্তৃতা শেষে লর্ড কেলভিন ও অলিভার লজ জগদীশচন্দ্রকে ইংল্যান্ডে থেকে কাজ করার আমন্ত্রণ জানান, কিন্তু জগদীশ রাজী হননি।
জগদীশের প্রায় একই সময় মাইক্রোওয়েভ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন ইতালির বিজ্ঞানী মার্কোনি। ১৯০২ সালে, জগদীশের প্রায় ৭ বছর পর মার্কোনি আটলান্টিকের অপর পারে বিনা তারে বার্তা প্রেরণে সক্ষম হন। তত দিনে জগদীশ পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা ছেড়ে উদ্ভিদবিজ্ঞানে গবেষণা শুরু করেছেন। তিনি উদ্ভিদের স্নায়ু, স্বতঃস্পন্দন, আবেগ, অনুভূতি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।

তাঁর এসব গবেষণার মূলে রয়েছে উদ্ভিদ ও প্রাণীর মধ্যে ঐক্যের সম্বন্ধ স্থাপন। প্রাণী ও উদ্ভিদের মধ্যে এ ঐক্য অন্বেষণ করতে গিয়ে জগদীশ প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, বৃক্ষের স্নায়ু আছে। এটি প্রমাণ করতে গিয়ে জগদীশকে পাশ্চাত্য বিজ্ঞানীদের রোষানলেও পড়তে হয়েছে। একজন পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে উদ্ভিদবিজ্ঞানে তাঁর এ গবেষণাকে অনেকে দেখেছেন অনধিকারচর্চা হিসেবে। কিন্তু জগদীশ জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মধ্যে এ বিভেদ মানতে রাজি নন। তাই জগদীশ বলেন, 'পাশ্চাত্য দেশে জ্ঞানরাজ্যে এখন ভেদবুদ্ধির অত্যন্ত প্রচলন হইয়ছে। সেখানে জ্ঞানের প্রত্যেক শাখা-প্রশাখা নিজেকে স্বতন্ত্র রাখিবার জন্যই বিশেষ আয়োজন করিয়াছে; তাহার ফলে নিজেকে এক করিয়া জানিবার চেষ্টা এখন লুপ্তপ্রায় হইয়াছে। জ্ঞান-সাধনার প্রথমাবস্থায় এরূপ জাতিভেদ প্রথায় উপকার করে, তাহাতে উপকরণ সংগ্রহ করা এবং তাহাকে সজ্জিত করিবার সুবিধা হয়; কিন্তু শেষ পর্য্যন্ত যদি কেবল এই প্রথাকেই অনুসরণ করি তাহা হইলে সত্যের পূর্ণমূর্ত্তি প্রত্যক্ষ করা ঘটিয়া উঠে না; কেবল সাধনাই চলিতে থাকে, সিদ্ধির দর্শন পাই না।'

জগদীশ দৃঢ়তার সঙ্গে উদ্ভিদবিজ্ঞানে তাঁর গবেষণা চালিয়ে যান। পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থার যে ধারা, তার বিপরীতে তিনি গড়ে তোলেন সম্পূর্ণ নতুন এক ধারা। জগদীশের এ গবেষণার মধ্য দিয়ে আন্তঃবিষয়ী গবেষণার এক অভিনব ধারার দ্বার উন্মোচিত হয়, যার নাম জৈবপদার্থবিজ্ঞান। জগদীশ হয়ে ওঠেন এ ধারার পথিকৃৎ। ইতিহাসে জগদীশচন্দ্র বসু হয়ে ওঠেন প্রথম জৈবপদার্থবিজ্ঞানী।

জগদীশচন্দ্র বসুর উদ্ভাবিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলো এতই অভিনব যে, তখনকার বিজ্ঞানীদের পক্ষে তা মেনে নেয়া খুব সহজ ছিল না। এ কারণে তাঁর প্রতিটি তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য উপযুক্ত যন্ত্রপাতি প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কিন্তু আধুনিক যন্ত্রসামগ্রী তৈরির জন্য কোনো রকমের আধুনিক প্রযুক্তি ও সুযোগ-সুবিধা তাঁর ছিল না। তাই টিনের পাত, লোহার চাকতি, কাঠের টুকরা ইত্যাদি অব্যবহৃত অকেজো বস্তুসামগ্রী দিয়ে নিজে সামনে দাঁড়িয়ে থেকে সাধারণ কামার-মিস্ত্রি দিয়ে তৈরি করিয়ে নিতে থাকলেন বিজ্ঞান গবেষণার আধুনিক সব যন্ত্রপাতি। এভাবেই তিনি একে একে তৈরি করেন ৫ মিলিমিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট বিদ্যুৎ তরঙ্গ সৃষ্টির যন্ত্র, কোহেরার, কালেকটিং ফানেল, হর্ন এন্টেনা, সমাবর্তক (চড়ষধৎরংবৎ) ও বিশ্লেষক যন্ত্র (অহধষুংবৎ), স্ট্রেন সেল, চৌম্বক-লিভার রেকর্ডার, রেজোন্যান্ট রেকর্ডার, ইলেকট্রিক প্রোব, ফাইটোগ্রাফ, শোষণগ্রাফ (ফটোগ্রাফ), স্বয়ংক্রিয় ফটোগ্রাফ, বাবলার ইনস্ট্রুমেন্ট, প্লান্ট সিসমোগ্রাফ, ক্রেসকোগ্রাফ, চৌম্বক ক্রেসকোগ্রাফ, স্বয়ংক্রিয় ফটোসিনথেসিস রেকর্ডার ইত্যাদি। শোনা যায়, তিনি দুই শতাধিক যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেন।

জগদীশ যখন পৃথিবী-বিখ্যাত বিজ্ঞানী, রবীন্দ্রনাথ তখন অপার সম্ভাবনার এক তরুণ কবি। ১৮৯৭ সালে ইউরোপ জয় করে বিজয়বেশে জগদীশ যখন কলকাতায় ফিরে আসেন, তখন রেলস্টেশনে তাঁকে অভিবাদন জানাতে উপস্থিত ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, আনন্দমোহন বসু প্রমুখ। এর কিছুদিন পরে পৃথিবী-বিখ্যাত এ বিজ্ঞানীকে শুভেচ্ছা জানাতে ছুটে যান স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। তাঁকে না পেয়ে শুভেচ্ছা স্মারক হিসেবে রেখে আসেন একগুচ্ছ ম্যাগনোলিয়া ফুল আর একটি চিঠি। এর কয়েক দিন পর রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন 'জগদীশচন্দ্র বসু' শিরোনামের একটি কবিতা। এর পর থেকে তাঁদের বন্ধুত্ব শুরু। রবীন্দ্রনাথ যেমন উৎসাহ দিয়ে বন্ধুর বিজ্ঞান গবেষণায় উজ্জীবিত রাখেন, জগদীশও তেমনি রবীন্দ্রনাথকে সাহিত্য রচনায় উৎসাহিত করে তোলেন।

ইউরোপে জগদীশচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য অনুবাদ করে তাঁর ইউরোপীয় বন্ধুদের পড়ে শোনাতেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে লেখা চিঠিতে জগদীশ বলেন, 'তোমার পুস্তকের জন্য আমি অনেক মতলব করিয়াছি। তোমাকে যশোম-িত দেখিতে চাই। তুমি পল্লীগ্রামে থাকিতে পারিবে না। তোমার লেখা তর্জমা করিয়া এদেশীয় বন্ধুদিগকে শুনাইয়া থাকি, তাঁহারা অশ্রুসম্বরণ করিতে পারে না। তবে কী করিয়া ঢ়ঁনষরংয করিতে হইবে, এখনও জানি না। চঁনষরংযবৎ-রা ফাঁকি দিতে চায়।' জগদীশ চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিম-লে উঠে আসুক; রবির আলোয় সারা পৃথিবী আলোকিত হোক। বিজ্ঞান ও সাহিত্যের এক অপূর্ব সেতুবন্ধন হয়েছিল এ দুই মহান ব্যক্তির বন্ধুত্বের মাধ্যমে।

১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার অর্জনের মধ্য দিয়ে জগদীশের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা সফল হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের এ নোবেল বিজয়ে জগদীশের তাই আনন্দের সীমা-পরিসীমা রইল না। এ অনুভূতিতে জগদীশ লেখেন, 'পৃথিবীতে তোমাকে এতদিন জয়মাল্য ভূষিত না দেখিয়া বেদনা অনুভব করিয়াছি। আজ সেই দুঃখ দূর হইল। দেবতার এই করুণার জন্য কি করিয়া আমার কৃতজ্ঞতা জানাইব? চিরকাল শক্তিশালী হও, চিরকাল জয়যুক্ত হও। ধর্মর্ তোমার চিরসহায় হউন।'
রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তি উপলক্ষে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথকে যে অভিনন্দন জ্ঞাপন করা হয়, তার সভাপতি ছিলেন স্বয়ং জগদীশচন্দ্র বসু।
১৯১৭ সালের ৩০ নভেম্বর নিজের ৫৯তম জন্মদিনে কলকাতায় বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি নিজ দেশে একটি বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন। বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তাঁর দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন শুরু হয়।
জগদীশ তাঁর জীবদ্দশায় অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন।
১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ভারত সরকার তাঁকে সিআইই (ঈযধসঢ়রড়হংযরঢ় ড়ভ ঃযব ওহফরধহ ঊসঢ়রৎব) উপাধি, ১৯১২ সালে জগদীশ সিএসআই (ঈড়সঢ়ধহরড়হংযরঢ় ড়ভ ঃযব ংঃধৎ ড়ভ ওহফরধ) উপাধি, ১৯১৭ সালে নাইট উপাধিতে ভূষিত হন তিনি। ১৯২৬ সালে বেলজিয়ামের রাজা জগদীশচন্দ্র বসুকে রাজকীয় কমান্ডার অব দি অর্ডার অব লিওপোল্ড উপাধিতে ভূষিত করেন।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়, হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানজনক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে।
এছাড়া ১৯২০ লন্ডন রয়েল সোসাইটির সদস্য নির্বাচিত হন। পৃথিবীর যে কোনো বিজ্ঞানীর জন্যই এটি একটি বিরাট স্বীকৃতি। জগদীশচন্দ্র বসুই হলেন ভারতবর্ষের প্রথম বিজ্ঞানী, যিনি রয়েল সোসাইটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯২৯ সালে দশমবারের জন্য ইউরোপ যাত্রা করেন এবং ফিনল্যান্ডের বিজ্ঞান সমিতি কর্তৃক সংবর্ধিত হন।

১৯৩৭ সালের ২ নভেম্বর রায়বাহাদুর এএন মিত্রের আমন্ত্রণে সস্ত্রীক গিরিডি যাত্রা করেন। ২৩ নভেম্বর সকাল ৮টায় গিরিডিতে হঠাৎ বাথরুমে হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন। ২৪ নভেম্বর ভোর ৪টা ১২ মিনিটে গিরিডিতে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর মরদেহ নিয়ে আসা হয় বসু বিজ্ঞান মন্দিরে। সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে মরদেহ নিয়ে শেষ যাত্রা শুরু হয়; আর পার্ক সার্কাস ক্রিমেটরিয়ামে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
জগদীশের আজন্ম সাধনা ছিল সত্য অনুসন্ধান। জগদীশ জানতেন সত্যই জ্ঞান। জগদীশ মনে করতেন কবি, ঋষি, বিজ্ঞানী সবাই জ্ঞানের সাধক, সত্যের সাধক। কবি ও বিজ্ঞানীর সত্য অনুসন্ধিৎসার প্রসঙ্গে জগদীশ বলেছেন, 'বৈজ্ঞানিক ও কবি, উভয়েরই অনুভূতি অনির্ব্বচনীয় একের সন্ধানে বাহির হইয়াছে। প্রভেদ এই, কবি পথের কথা ভাবেন না, বৈজ্ঞানিক পথটাকে উপেক্ষা করেন না।'

জগদীশচন্দ্র বসু বিজ্ঞানের পথেই সত্য অনুসন্ধান করতে চেয়েছেন। এ কারণেই তিনি 'বিশ্বাসের সত্য'কে 'বিজ্ঞানের সত্য' দিয়ে যাচাই করে এ দুয়ের ব্যবধান ঘোচাতে চেয়েছেন। বালক বয়সে জগদীশ চেয়েছিলেন উঁচু-নিচুর ব্যবধান ঘোচাতে। তরুণ বয়সে চেয়েছিলেন শাসক আর শোষিতের ব্যবধান ঘোচাতে। পরিণত বয়সে জগদীশের এ চেতনাই যেন পরিপক্ব হয়ে আরও উন্নত হয়ে ধরা দিয়েছিল তাঁর গবেষণায়। এ কারণেই তিনি ঘোচাতে চেয়েছেন পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের ব্যবধান, বিজ্ঞান-সাহিত্যের ব্যবধান, উদ্ভিদ-প্রাণীর ব্যবধান, এমনকি সপ্রাণ-অপ্রাণের ব্যবধানও। জগদীশের আজন্ম সাধনা ছিল এ ব্যবধান ঘোচানো। এ ব্যবধান ঘোচাতে গিয়ে জগদীশ সাফল্যের এমন এক গগনচুম্বী উচ্চতায় আরোহণ করেছেন, যেখানে খুব কম লোকের পক্ষেই যাওয়া সম্ভব। পৃথিবীর অসাধারণ সফল মানুষের মধ্যেও জগদীশ আলাদা। বাঙালির মধ্যে জগদীশ অনন্য, সবার চেয়ে এগিয়ে। এ কারণেই জগদীশ আজও প্রাসঙ্গিক, জগদীশ আজও গুরুত্বপূর্ণ।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন