মঙ্গলবার, ২৯ আগস্ট, ২০২৩

'কে বাঁচায় কে বাঁচে' গল্পের টুনুর মা চরিত্রটি পর্যালোচনা কর ?




মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কে বাঁচায় কে বাঁচে ছোট গল্পের নায়ক মৃত্যুঞ্জয়ের স্বামী অন্ত প্রাণ সহধর্মিনী হলো মমতাময়ী নারী টুনুর মা। নামহীন এই চরিত্রটি শারীরিকভাবে শির্না ও রোগা হলেও মন্বন্তরের বীভৎসতায় নিজের  পরিবার  সম্পর্কে উদাসীন হয়ে যাওয়া স্বামীর  অস্থিরতাকে সে কেবল মেনে নেইনি, মনেও  নিয়েছে। সে যে তার স্বামীকে ভালোবাসতো এবং তার আদর্শকে সম্মান করতো তা ই  নয় । সে নিজেও ছিল  উদার  হৃদয় এবং মমতাময়ী ।
শয্যাশায়ী অবস্থায় সে বারবার নিজের স্বামীর খোঁজ খবর করেছে, স্বামীর সহকর্মী বন্ধু  নিখিল কেউ সকাতর অনুরোধ করেছে তার স্বামীর খেয়াল রাখতে সঙ্গে থাকতে । দুই-তিনবার সে স্বামীর ফুটপাথে দুর্ভিক্ষ পীড়িত অনাহার মানুষগুলোকে দেখে বেড়ানোর সঙ্গী ও  হয়েছে । নিখিল কে সে জানায় উঠতে পারলে আমি তো  সঙ্গে ঘুরতাম ঠাকুরপো। মৃত্যুঞ্জয় এর ব্যাপারে টুনুর মা আরও জানিয়েছেন একেবারে মুষরে ছেড়ে যাচ্ছেন দিনকে দিন।

নিখিল কে সে বলেছে , উনি পাগল হয়ে যাচ্ছেন আমারও মনে হচ্ছে যেন পাগল হয়ে যাব। ছেলে মেয়ে গুলির জন্য সত্যিই আমার ভাবনা হয় না। কেবলই মনে পড়ে ফুটপাতের ওই লোক গুলির  কথা। এভাবেই মৃত্যুঞ্জয় আদর্শবাদের সঙ্গী হয়ে যায় টুনুর  মা।
সুতরাং, টুনুর মা  এ  গল্পের প্রধান চরিত্র হলেও গল্পের প্রধান চরিত্র মৃত্যুঞ্জয়কে উজ্জ্বল করে তুলে ধরার এই চরিত্রটি  ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে ।

কে বাঁচায় কে বাঁচে ছোটগল্পের নিখিল চরিত্রটি পর্যালোচনা কর ??



উত্তর:-  মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের " কে বাঁচায় কে বাঁচে " ছোটগল্পের নায়ক  মৃত্যুঞ্জয় অফিসের সহকর্মী বন্ধু ছিল নিখিল । প্রখর বুদ্ধিমান এই রোগা যুবকটি ছিল কিছুটা অলস প্রকৃতির । দুই সন্তানের পিতা নিখিলের সংসারে বিশেষ  মন নেই বলে কেউ কেউ মনে করতেন। বইপত্র পড়ে এবং নিজের ভাবনার জগতে বিচরন করেই অবসর সময় কাটা তো এই অন্তর্মূখী যুবকটি।
অফিসের সহকর্মী বন্ধু মৃতুঞ্জয়ের  মাইনে নিখিলে থেকে সামান্য কিছু বেশি হলেও অন্য সকলের মতো নিখিল ও তাকে তাকে বেশ পছন্দ করত । হয়তো তাতে কিছুটা অবজ্ঞা মিশ্রিত ভালোবাসা জড়িয়ে থাকতো । তবে মৃত্যুঞ্জয়ের মানসিক শক্তির কাছে নিখিল কিছুটা যেন নিস্তেজ ছিল। মাঝে মাঝে তার এই ভেবে আফসোস হত রে সে চদি নিখিল না হয়ে মৃত্যুঞ্জয় হত তাহলে মন্দ হত না । এর থেকে মৃত্যুঞ্জয়ের প্রতি তার সহকর্মী নিখিলের মৃদু ঈষার  পরিচয় ও পাওয়া যায়।

[   ] তবে নিখিল স্বার্থপর ছিলনা । প্রতিমাসে তিন জায়গায় তাকে অর্থ সাহায্য পাঠাতে দেখা যায়। তাছাড়া মৃত্যুঞ্জয় কে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে দীর্ঘদিন ধরে সে সচেষ্ট থেকেছে, তার পরিবারের খোঁজ খবর নিয়েছে এবং মৃত্যুঞ্জয় অফিসে যাওয়া বন্ধ করলে তার ছুটির ব্যবস্থা ও করেছে ।
হৃদয়বান , সামাজিক যুবক নিখিল ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে   দুঃখি হলেও প্রিয় বন্ধু মৃত্যুঞ্জয় মতো একেবারে ভেঙ্গে পড়েনি । তাছাড়া মাইনের  পুরো টাকাটা মৃত্যুঞ্জয় ত্রাণ তহবিলে দান করলে সে তার প্রতিবাদ করেছি এ কথা ভেবে যে এভাবে দেশের লোক কে বাঁচানো যায় না।   মৃত্যুঞ্জয়ের   পরিবারের প্রতি আন্তরিক ভাবনা ও তার কথায় প্রতিফলিত হয়েছে। সাধারণ মানুষের মতোই সে এই যৌক্তিক কথা ই  নিজে না খাইয়া মারা বড় পাপ।


[    ]  সুতরাং,  চরিত্রের বিভিন্ন দিক গুলি পর্যালোচনা করে বলা যায় যে সে এ গল্পের হৃদয়বান এক বাস্তব বাদী  চরিত্র।

অতীত স্মরণ কয়েকটি গুরুত্ব পূর্ণ প্রশ্ন




১) লোক কথার উল্লেখ যোগ্য সূত্র গুলি অর্থাৎ এপিক ল্য - গুলির পরিচয় দাও ?

২) পেশাদারী শাখা হিসেবে ইতিহাসের গুরুত্ব লেখো ?

৩) আধুনিক ইতিহাস লিখন পদ্ধতি ?

৪) জাদুঘরের সংজ্ঞা এবং এর উদ্দেশ্য বা কার্যাবলী লেখো ?

বিভাব নাটকের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন




১) তাই অনেক ভেবচিন্তে আমরা একটা প্যাঁচ বের করেছি ।  কে কোন প্রসঙ্গে মন্তব্যটি করেছেন তা আলোচনা করো ।

২) বুদ্ধিটা কি করে এল তা বলি । কোন বুদ্ধি এবং তা কীভাবে এল – নাট্যকারকে অনুসরণ করে আলোচনা করো ।

৩) এবার নিশ্চয়ই লোকের খুব হাসি পাবে ? সমগ্র নাট্যকাহিনীর নিরিখে মন্তব্যটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো ।

৪) এই ঘরের মধ্যে জীবনকে উপলদ্ধি করা যাবে না । জীবনকে উপলদ্ধি করার জন্য বক্তা কী করেছিলেন ? শেষে তার কীরূপ অভিজ্ঞা হয়েছিল ।

৫) বিভাব নাটকের মূল বক্তব্য সংক্ষেপে আলোচনা করো ।

৬) তাহলে আপনার হাসি জীবনে কোনোদিন পাবে না । বক্তার এই মন্তব্যের কারন " বিভাব " নাটক অবলম্বনে আলোচনা করো ।

৭) তবে হ্যা , মানতে পারে , যদি সাহেবে মানে । যেমন রবি – ঠাকুরকে মেনেছিল । মন্তব্যটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ সহ আলোচনা করো ।



শক্তি চট্টোপাধ্যায় জীবনী মূলক রচনা




জন্ম ও পারিবারিক পরিচয় :– জীবানন্দ পরবর্তী বাংলা  সাহিত্যর অন্যতম প্রধান আধুনিক কবি ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় । ১৯৩৩ সালে ২৫ নভেম্বর দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বহরুতে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম হয় । তার পিতা বামানাথ চট্টোপাধ্যায় এবং মাতা কমলাদেবী । কবির শৈশবের কিছুটা অংশ কেটেছে তার মামার বাড়িতে । চল্লিশের দশকে তিনি কলকাতার বাগবাজারে মামার বাড়িতে থাকতেন ।


ছাত্রজীবন :– হাতের কাজের প্রতি আগ্রহ থাকায় ছোটোবেলায় কবি ভরতি হন কাশিমবাজার পলিটেকনিক স্কুলে । ছাত্রজীবন থেকেই কবিতা লেখা শুরু করেন তিনি । অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় হরিপদ কুশারীর প্রভাবে কবি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন । তিনি " রূপচাঁদ পক্ষী " ছদ্ম নামে কবিতা লেখা শুরু করেন । স্কুলে পড়াকালীনই শক্তি চট্টোপাধ্যায় " নবোদয় " নামের একটি হাতে লেখা পত্রিকা বের করেন । স্কুলের পাঠ সমাপ্ত করে এরপর তিনি বাংলা সাহিত্যে অনাস নিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভরতি হন । কিন্তু কমিউনিস্ট আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য শক্তি চট্টোপাধ্যায় ছাত্র রাজনীতির কারনেই ডিসকলেজিয়েট হন । ফলে কলেজের পাঠ তার শেষ করা হয়নি । পরবর্তীকালে কবি বুদ্ধদেব বসুর প্রেরনায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য ভরতি হলেও কয়েক মাসের মধ্যেই সেখানের পরাতেও তিনি ইতি টানেন ।


কর্মজীবন :– কবির প্রথম চাকরি ছিল " ক্লারিয়ণ " নামক এক বিজ্ঞাপন কোম্পানিতে কপিরাইটার কাজ । পরবর্তীকালে তিনি " ভারবি " প্রকাশনা সংস্থায় যোগ দেন । শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পরিকল্পনাতেই এই প্রকাশনা সংস্থা থেকে " শ্রেষ্ট কবিতা " সিরিজটি প্রকাশিত হতে শুরু করে । এই সময়ে বন্ধু পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় একটি টিউটোরিয়াল হোম খোলেন তিনি । পরবর্তীকালে বিশ্বভারতীতে তিনি অতিথি অধ্যাপক হিসেবে যুক্ত ছিলেন ।


সাহিত্যকর্ম :– বুদ্ধদেব বসুর " কবিতা " পত্রিকার প্রকাশিত হয় শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের " যম " কবিতাটি । এটিই তার প্রথম প্রকাশিত কবিতা । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর তিনি তার " কৃত্তিবাস " পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন  এবং এই পত্রিকার অন্যতম প্রধান কবি হয়ে ওঠেন ।

[         ] ধীরে ধীরে শক্তি চট্টোপাধ্যায় পঞ্চাশের দশকের একজন শক্তিশালী ও জনপ্রিয় কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন । কবিতা রচনাই তার একমাত্র আশ্রয় । তিনি কবিতাকে " পদ্য " বলতেন ।  "স্ফুলিঙ্গ সমাদ্দার " নামে তিনি গদ্যচর্চাও করেছেন । ১৯৬১ সালে তিনি " কুয়োতলা " নামে তার প্রথম উপন্যাসটি লেখেন । প্রকৃতির পাশাপাশি প্রেম , নারী এবং মানুষকে নিয়েও তিনি কবিতা লিখেছেন । তার জীবন ছিল বেপরোয়া এবং বন্ধহীন । যুগের যন্ত্রণাকে গায়ে মেখে তিনি অস্থিরতায় ছট্ফট করেছেন । কবির উল্লেখযোগ্য কাব্য গুলি হলো – " ধর্মে আছো জিরাফেও আছো " ঈশ্বর থাকেন জ্বলে " সোনার মাছি খুন করেছি " প্রভু নষ্ট হয়ে যায় " ইত্যাদি । তার লেখা উল্লেখযোগ্য ছোটো গল্প " নিরূপমের দুঃখ " । এছাড়াও তিনি " মেঘদূত " গালিব প্রমুখের কবিতা অনুবাদ করেছেন ।

সম্মান ও স্বীকৃতি :– " যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো " কাব্য গ্রন্থের জন্য ১৯৮৩ সালে তিনি " একাডেমী পুরস্কার " লাভ করেন ।

জীবনাবসান :– ১৯৯৫ সালে ২৩ মার্চ শান্তিনিকেতনে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যু ঘটে ।




বেগম রোকেয়া জীবনী মূলক রচনা



ভূমিকাঃ বাঙালি মুসলিম সমাজের নারীদের অন্ধকারময় পৃথিবীতে আলোকবার্তা হাতে এসেছিলেন বেগম রোকেয়া। তার সকল কর্মের মূলে ছিল নারীমুক্তির স্বপ্ন। এই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে গিয়েই তিনি একদিকে কলম তুলে নিয়েছিলেন, অন্যদিকে নারীদের নতুন পথের সন্ধান দেখিয়েছিলেন। এ কারণেই তিনি আজও ‘নারী জাগরণের অগ্রদূত’ হিসেবে পরিচিত।

জন্ম ও শৈশবজীবনঃ বেগম রোকেয়ার জন্ম ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার পায়রাবন্দ গ্রামের এক জমিদার পরিবারে। বেগম রোকেয়ার পারিবারিক নাম রোকেয়া খাতুন। তার পিতার নাম জহিরুদ্দিন মুহম্মদ আবু আলী সাবের এবং মাতার নাম রাহাতুন্নেসা। বেগম রোকেয়া যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন তাঁদের জমিদারি অনেকটা পড়ন্ত দশায় ছিল। তবুও তার শৈশব কাটে তৎকালীন মুসলমান জমিদারি রীতি অনুযায়ী কঠোর পর্দা ও অবরোধের মধ্যে। তার নিজের ভাষায় “অবিবাহিত বালিকাদিগকে অতি ঘনিষ্ঠ আত্মীয় এবং বাড়ির চাকরাণী ব্যতীত অপর কোনো স্ত্রীলোক দেখিতে পায় না।” এমন কঠোর পর্দা প্রথার মধ্যেই বেগম রোকেয়ার বেড়ে ওঠা।

শিক্ষাজীবনঃ বিশ্বের অনেক কৃতী ব্যক্তির মতো বেগম রোকেয়াও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করতে পারেননি। নিজের প্রবল আগ্রহ ও কিছু মানুষের সহায়তায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন স্বশিক্ষিত। তাইতো সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল চালু করার সময় প্রথমদিকে বিদ্যালয়ের শিক্ষাদান সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই ছিল না। সামসুন্নাহার মাহমুদের ভাষায়- “রোকেয়া যখন প্রথম পাঁচটি ছাত্রী নিয়ে বালিকা স্কুল স্থাপন করেন, তখন তিনি ভেবে পাননি কী করে একজন শিক্ষয়িত্রী একই সঙ্গে পাঁচটি মেয়েকে পড়াতে পারে।” তবে তিনি বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, ফার্সি প্রভৃতি ভাষা সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান লাভ করেছিলেন। তার সাহিত্যে আমরা এর পরিচয় পাই।


জীবনে অনুপ্রেরণার উৎসঃ বেগম রোকেয়া যে মুসলিম সমাজে বেড়ে উঠেছিল সেখানে স্ত্রীশিক্ষা হিসেবে প্রচলিত ছিল ‘টিয়া পাখির মতো কোরান শরীফ’ পাঠ, নামাজ, রোজা ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান সম্পর্কে জ্ঞান। এছাড়া স্বামী বা নিকট আত্মীয়কে চিঠি লিখতে পারা, দু-একটি উর্দু-ফারসি পুঁথি পুস্তক পড়ার ক্ষমতা, সেলাই, রান্না ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তখন মেয়েদের বাংলা শিক্ষা ছিল অনেকটা নিষিদ্ধ। কিন্তু এমন সমাজের মধ্যেও বেগম রোকেয়ার বড় বোন করিমুন্নেসা একটু আধটু বাংলা পড়েছিলেন এবং ছদ্মনামে বেশ কয়েকটা কবিতাও লিখেছিলেন। করিমুন্নেসার বিদ্যানুরাগ বেগম রোকেয়াকে অনুপ্রেরণা যোগায়। এর সাথে বড় ভাই ইব্রাহিম সাবেরের প্রচেষ্টায় তিনি শৈশব থেকে কুসংস্কারকে ঘৃণা করতে শেখেন এবং বিদ্যার্জন করেন। বিয়ের পর স্বামী সাখাওয়াত হোসেনও তাকে এক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন।


বিবাহিত জীবনঃ উর্দুভাষী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বেগম রোকেয়ার বিয়ে হয়। তাদের বিয়ের সময় বেগম রোকেয়ার বয়স ছিল ১৬ এবং সাখাওয়াত হোসেনের ছিল ৩৮ বছর। সাখাওয়াত হোসেন প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাকে বিয়ে করেন। ব্যক্তি হিসেবে সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন একজন উদারমনা, রুচিশীল, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ও কুসংস্কার বিরোধী মানুষ। এছাড়া স্ত্রীশিক্ষার পক্ষপাতীও ছিলেন তিনি। তাইতো তিনি বেগম রোকেয়াকে ইংরেজি শিক্ষার ব্যাপারে উৎসাহিত করেন। এমনকি ১৯০৯ সালে মৃত্যুর আগেই মেয়েদের শিক্ষার জন্য দশ হাজার টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। বেগম রোকেয়া ছিলেন নিঃসন্তান। তার দু’টি কন্যা সন্তান জন্ম হয়েছিল। কিন্তু তাদের অকাল মৃত্যু হয়।


বাংলা ভাষা চর্চায় প্রতিবন্ধকতাঃ উর্দুর প্রবল প্রতিকূল স্রোতে বাংলা ভাষাকে প্রাণপ্রণে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন বেগম রোকেয়া। তার স্বামী ও অভিভাবকরা সবাই ছিলেন বাংলা ভাষার বিরোধী। কিন্তু এর মাঝেও তিনি বাংলা ভাষার চর্চা অব্যাহত রেখেছিলেন। এছাড়া স্বামী সাখাওয়াত হোসেনকে বাংলা শেখাবার ব্রতও নিয়েছিলেন। বাংলা ভাষার চর্চা অব্যাহত রাখতে তাকে যে নিদারুণ সংগ্রাম করতে হয়েছিল তার বর্ণনা ‘মতিচূর’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডের করিমুন্নেসার নামে উৎসর্গ পত্রে রয়েছে।


ইংরেজি ভাষার চর্চাঃ বেগম রোকেয়া বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ না করলেও ইংরেজি ভাষার ওপর তার যথেষ্ট দখল ছিল। তার লেখা ওলফভট্র, Sultana's Dream-এর প্রমাণ। এছাড়া বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিদের কাছে দেয়া ইংরেজিতে লেখা চিঠিও এর প্রমাণ বহন করে।


সাহিত্য কর্মঃ আধুনিক জাগরণশীল বাঙালি মুসলিম সমাজে বেগম রোকেয়াই প্রথম উল্লেখযোগ্য লেখিকা। সাহিত্য ক্ষেত্রে তিনি মিসেস আর এস হোসেন নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা পিপাসা । ১৯০১ সালে ‘নবপ্রভা’ পত্রিকায় এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এছাড়া তাঁর বিভিন্ন লেখা নবনূর, সওগাত, মোহাম্মদী ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত হত। তার গ্রন্থের সংখ্যা পাঁচটি। এগুলো হলো- মতিচূর (প্রথম খন্ড), সুলতানার স্বপ্ন, মতিচূর (দ্বিতীয় খন্ড), পদ্মরাগ ও অবরোধবাসিনী। এছাড়া সম্প্রতিকালে বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে আরও কিছু রচনা ও চিঠিপত্র পাওয়া গেছে।


সাহিত্য ও নারী মুক্তিঃ
“সুকঠিন গার্হস্থ্য ব্যাপারসুশৃঙ্খলে কে পারে চালাতেরাজ্যশাসনের রীতিনীতিসূক্ষ্মভাবে রয়েছে ইহাতে।”বেগম রোকেয়া এই কথাটি শুধু মুখেই বলেননি তা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন। তাইতো নারীদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে নারীর মানবীয় সত্তার প্রতিষ্ঠা কামনা করেছেন। মুসলিম নারী সমাজের কুসংস্কারের জাল ছিন্ন করতে এবং জড়তা দূর করতে তিনি সাহিত্যকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তিনি বলতেন- “না জাগিলে ভারত ললনা, এ ভারত আর জাগিবে না।” তাই তিনি তার লেখার মাধ্যমে নারীর জাগরণের জন্য লড়াই করেছেন। মুক্তিফল গল্পে তাই বলেছেন- “কন্যারা জাগ্রত না হওয়া পর্যন্ত দেশমাতৃকার মুক্তি অসম্ভব।” বেগম রোকেয়ার মতে এই জাগরণের প্রধান শর্ত শিক্ষা। তার ভাষায় “আমরা পুরুষের ন্যায় সাম্যক সুবিধা না পাইয়া পশ্চাতে পড়িয়া আছি।” তিনি বুঝেছিলেন শিক্ষাই হলো স্বনির্ভরতার সোপান। তাই শিক্ষাকে তিনি জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত দুর্ভাগ্য, আর্থিক সমস্যা, সামাজিক বাধা, লোকনিন্দা কোনো কিছুই তাকে এই ব্রত থেকে সরাতে পারেনি। তাইতো স্ত্রী জাতির অবনতি, অর্ধাঙ্গী, সুগৃহিনী, বোরকা, গৃহ, জাগো গো ভগিনী প্রভৃতি প্রবন্ধে তিনি এই শিক্ষার জয়গানই গেয়েছেন, দিয়েছেন নারী মুক্তির দীক্ষা।


সমাজ সংগঠকঃ বেগম রোকেয়া কেবল লেখিকাই নন, নারী জাগরণের অন্যতম অগ্রপথিক ছিলেন। তিনি ১৯০৯ সালে ১ অক্টোবর ভাগলপুরে পাঁচজন ছাত্রী নিয়ে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করেই তিনি একটি আন্দোলনের সৃষ্টি করেন। এই ধারাই শিক্ষার ধারাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে তিনি ১৯১৬ সালে “আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম” নামে একটি মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই বিদ্যালয় ও নারী সমিতির কাজে তিনি নিয়োজিত ছিলেন।


অন্তিম যাত্রাঃ বেগম রোকেয়া ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর ৫২ বছর বয়সে আকস্মিক হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগের রাতেও এগারোটা পর্যন্ত তিনি “নারীর অধিকার” নামক একটি প্রবন্ধ লেখার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। কলকাতার কাছাকাছি চব্বিশ পরগনা জেলার অন্তর্গত সোদপুরে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। তার স্মরণে প্রথমে কলকাতার আলবার্ট হলে (বর্তমান কফি হাউজ) ও পরে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলে দুটি শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই শোকসভায় হিন্দু মুসলমান একই সাথে যোগদান করেছিলেন। সেখানে এক ভাষণে সৈয়দ এমদাদ আলী বলেছিলেন- “তাহার স্মৃতির উপরে আজ বাংলার মুসলমান সমাজ যে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতেছেন, বাংলার কোনো মুসলমান পুরুষের মৃত্যুতে সেরূপ করিয়াছেন বলিয়া জানি না।”


উপসংহারঃ বাঙালি মুসলিম সমাজে নারীমুক্তির অগ্রদূত হিসেবে বেগম রোকেয়ার আবির্ভাব সত্যিই বিস্ময়কর। কারণ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সংগ্রাম করেছিলেন নারীমুক্তির লক্ষ্যে, নারীশিক্ষার লক্ষ্যে। বর্তমান নারী সমাজ যে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারছে তার অনেকটাই বেগম রোকেয়ার অবদান। এ জন্যই ২০০৪ সালের বিবিসি জরিপে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় তিনি ষষ্ঠ অবস্থানে ছিলেন। তাই আবুল হুসেনের ভাষায় বলা যায়- “তাহার মতো চিন্তাশীল নারী প্রকৃতই নারীজাতি কেনো, সমগ্র মানবজাতির গৌরবের পাত্রী।”



সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ জীবনী মূলক রচনা



জন্ম ও পারিবারিক পরিচয় :– সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ ১৯৩০ খিস্টাবদের ১৪ অক্টোবর মুর্শিদাবাদ জেলার খোশবাস পুর গ্রামে এক অভিজাত মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি এমন একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন যেখানে শিক্ষা এবং সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার একটা সুন্দর পরিবেশ ছিল । শুধু তাই নয় , আরবি , ফারসি , সংস্কৃত প্রভুতি ভাষার চর্চাও হত তার পরিবারে । লেখকের মা আনোয়ার বেগম ছিলেন একজন খ্যাতনামা কবি । সে কারনেই শৈশব থেকেই সিরাজ হৃদয় দিয়ে সাহিত্য রস আস্বাদন করতে শিখে ছিলেন । 

ছাত্রজীবন :– সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ ১৯৪৬ খিস্টাবদে বর্ধমান জেলার " গোপালপুর মুক্তকেশী বিদ্যালয় " থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন । বহরম পুর কৃষ্ণ নাথ কলেজ থেকে এরপর তিনি স্নাতক হন । স্কুলজীবন থেকেই বাইরের বই পড়ার আগ্রহ তৈরী হয় তার । 

কর্মজীবন :– যৌবনের শুরুতেই সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ বামপন্থি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন । সেই সূত্রেই তিনি লোকনাট্য দল " আলকাপ " _ এর সঙ্গে যুক্ত হন  ১৯৫০ খিস্টাবদে । সেই দলে তিনি বাঁশি বাজাতেন  এবং লোকনাট্য ও লোক নৃতের প্রশিক্ষণ দিতেন । এই দলের সূত্রে তিনি গ্রামবাংলার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান এবং সেইসব স্থানের সমাজ ও অর্থনীতির সঙ্গে পরিচিত হন । বঙ্গদেশের বিভিন্ন জেলা যেমন মুর্শিদাবাদ , মালদা , বর্ধমান , বীরভূম এমনকি কলকাতাতেও তিনি এই কাজের সুত্রে ঘুরে বেড়াতেন । ১৯৫৬ খিস্টাবদ পযন্ত সিরাজ আলাপ _ এর দলের হয়ে সারারাত্রিব্যাপী  অনুষ্ঠান করতেন । তার পরবর্তী জীবনের লেখালেখিতে এই অভিজ্ঞা প্রভাব ফেলেছে ।

[       ] পরবর্তীকালে সিরাজের মনোভাবের পরিবর্তন ঘটে । তিনি অনুভব করেন যে , তার চারদিকে আরও বড় পৃথিবী পড়ে রয়েছে । অবশ্য তিনি আগেই কবিতা এবং ছোটো গল্প লেখা শুরু করেন । ১৯৫০ খিস্টাবদে "ইবলিশ" ছদ্মনামে লেখা তার প্রথম গল্প " কাঁচি " প্রকাশিত হয় বহরমপুরের " সুপ্রভাত " পত্রিকায় । ওই একই বছরে " দেশ " পত্রিকায় " শেষ অভিসার " নামক কবিতা প্রকাশিত হয় তার । ১৯৬২ তে সাপ্তাহিক " দেশ " পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তার লেখা গল্প " ভালোবাসা ও ডাউন ট্রেন " । ১৯৬৪ খিস্টাবদে তিনি " ভান্ডার " পত্রিকায় যোগ দেন । এর পাশাপাশি গল্প লেখা চলতে থাকে তার । এরপর ১৯৬৬ খিস্টাবদে তার প্রথম উপন্যাস " নীল ঘরের নটি " প্রকাশিত হলে তিনি ক্রমে ক্রমে উপন্যাসিক হিসেবে খ্যাতিলাভ করেন । ১৯৭১ – এ তিনি আনন্দবাজার পত্রিকায় যোগ দেন ।


সাহিত্যকর্ম :– সারাজীবন ধরে তিনি ১৫০ টির মতো উপন্যাস এবং ৩০০ টির মতো ছোটগল্প লিখেছেন । এগুলির মধ্যে " ইন্তিপিসি ও ঘাটবাবু " , ভালোবাসা ও ডাউন ট্রেন , মানুষের জন্ম , রণভূমি , রক্তের প্রত্যাশা , মাটি – প্রভুতি ছোটো গল্প এবং অলীক মানুষ , কৃষ্ণা বাড়ি ফেরেনি , প্রভুতি উপন্যাস উল্লেখযোগ্য । 

[       ] সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ ডিটেকটিভ চরিত্র " গোয়েন্দা কর্নেল "  । এই চরিত্রটি নিয়ে তিনি শিশু ও কিশোর – কিশোরীদের জন্য যেসব গোয়েন্দা – কাহিনী রচনা করেছেন , তা তাকে খ্যাতির তুঙ্গে নিয়ে যায় ।



সম্মান ও স্বীকৃতি :– সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ বহু পুরষ্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন । ১৯৭৯ খিস্টাবদে তিনি পান " আনন্দ পুরস্কার " । তার সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাস " অলীক মানুষ " _এর জন্য তিনি " বঙ্কিম পুরষ্কার " " এবং " সাহিত্য আকাদেমি পুরষ্কার " লাভ করেন । তিনি নরহরি দাস পুরষ্কার পান । ২০১০ _ এ তিনি পান বিদ্যাসাগর পুরষ্কার ।


জীবনাবসান :– ২০১২ সালে ৪ সেপ্টেম্বর ৮২ বছর বয়সে এই পন্ডিত সাহিত্যিকের মৃত্যু হয় । সত্বন্ত্র ধারার কথাসাহিত্যিক হিসেবে এবং গোয়েন্দা কর্নেল চরিত্রের শ্রেষ্ঠা হিসেবে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন ।