মঙ্গলবার, ২৯ আগস্ট, ২০২৩

হুমায়ূন আহমেদ জীবনী মূলক রচনা



জন্ম ও ছেলেবেলা :– হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ সালে ১৩ ই নভেম্বর তৎকালীন পাকিস্থানের ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত নেত্রকোনা মহুকুমার কেন্দুয়ারকুতুব পুরে জন্ম গ্রহণ করেন । তার পিতা শহীদ ফয়জুর রহমান আহমেদ এবং মা আয়েশা ফয়েজ । তার পিতা একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন এবং তিনি ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তৎকালীন পিরোজ পুর মহকুমার এস ডি পি ও ( উপ - বিভাগীয় পুলিশ অফিসার ) হিসেবে কর্তব্যরত অবস্থায় শহীদ হন । তার পিতা সাহিত্য অনুরাগী মানুষ ছিলেন । তিনি পত্র পত্রিকায় লেখা লেখি করতেন । বগুড়া থাকার সময় তিনি একটি গ্রন্থও প্রকাশ করেছিলেন । গ্রন্থের নাম " দ্বীপ নেভা যার ঘরে "। তার মা'র লেখালেখির অভ্যাস না থাকলেও একটি আত্মজীবনী গ্রন্থ রচনা করেছেন যার নাম " জীবন যে রকম " । পরিবারে সাহিত্যমনস্ক আবহাওয়ায় ছিল । তার অনুজ মুহম্মদ জাফর ইকবাল দেশের একজন বিজ্ঞান শিক্ষক এবং কথাসাহিত্যিক ; সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতা আহসান হাবিব রম্য সাহিত্যিক এবং কাঠুনিষ্ঠ । তার রচিত উপন্যাস থেকে জানা যায় যে ছোটকালে হুমায়ূন আহমেদের নাম রাখা হয়েছিল শামসুর রহমান ; ডাকনাম কাজল । তার পিতা  ( ফয়জুর রহমান ) নিজের নামের সাথে মিল রেখে ছেলের নাম রাখেন শামসুর রহমান । পরবর্তীতে আবার তিনি নিজেই ছেলের নাম পরিবর্তন করে হুমায়ূন আহমেদ রাখেন । হুমায়ূন আহমেদের ভাষায় , তার পিতা ছেলে মেয়ে দের নাম পরিবর্তন করতে পছন্দ করতেন । তার ছোট ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবালের নাম আগে ছিল বাবুল এবং ছোটবোন সুফিয়ার নাম ছিল শেফালী । ১৯৬২ - ৬৪ সালে চ্ট্ট গ্রামে থাকাকালীন হুমায়ূন আহমেদের নাম ছিল বাচ্চু ।


শিক্ষা এবং কর্মজীবন :– তার পিতা চাকরি সূত্রে দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করেছেন বিধায় হুমায়ূন আহমেদ দেশের বিভিন্ন স্কুলে লেখা পড়া করার সুযোগ পেয়েছন । তিনি বগুড়া জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন এবং রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন । তিনি পরে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই বিজ্ঞানে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন । তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন শাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন এবং প্রথম শ্রেণীতে বি এস সি ( সম্মান ) ও এম এস সি ডিগ্রি লাভ করেন । তিনি মুহসীন হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন এবং ৫৬৪ নং কক্ষে তার ছাত্রজীবন অতিবাহিত করেন । পরে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার রসায়ন বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি লাভ করেন । ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন । এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত থাকা অবস্থায় প্রথম বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী তোমাদের জন্য ভালোবাসা রচনা করেন । ১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন । লেখালেখিতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ায় এক সময় তিনি অধ্যাপনা ছেড়ে দেন । শিক্ষক হিসেবে ছাত্র ছাত্রীদের কাছে অত্যন্ত জন প্রিয় ছিলেন এই অধ্যাপক ।


সাহিত্যকৃতি :– সগৃহে বৈঠকি আড্ডায় হুমায়ূন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র জীবনে একটি উপন্যাস রচনা রচনার মধ্যে দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য জীবনের শুরু । এই উপন্যাসটির নাম নন্দিত নরকে । ১৯৭১–এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে উপন্যাসটি প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি । ১৯৭২ - এ কবি সাহিত্যিক  আহমেদ ছফার উদ্যেগে উপন্যাসটি খান ব্রাদাস কতৃর্ক গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয় । প্রখ্যাত বাংলা ভাষা শাস্ত্র পন্ডিত আহমেদ শরীফ সত্ব: প্রভৃও হয়ে এ গ্রন্থটির ভূমিকা লিখে দিলে বাংলাদেশের সাহিত্যমোদী মহলে কৌতুহল সৃষ্টি হয় । শঙ্খনীল কারাগার তার ২য় গ্রন্থ । মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি  দুই শতাধিক গল্পগ্রন্থ ও উপন্যাস রচনা করেছেন । তার রচনার প্রধান কয়েককটি বৈশিষ্টের মধ্যে অন্যতম হলো – ' গল্প সমৃদ্ধি ' । এছাড়া তিনি অনায়াসে ও বিশ্বাসযোগ্য ভাবে অতি বাস্তব ঘটনাবলীর অবতারনা করেন যাকে একরূপ যাদু বাস্তবতা হিসেবে গণ্য করা যায় । তার গল্প ও উপন্যাস সংলাপ প্রধান । তার বর্ননা পরিমিত এবং সামান্য পরিসরে কয়েকটি মাত্র বাক্যের মাধ্যমে চরিত্র চিত্রনের অদৃষ্ট পূর্ব প্রতিভা তার রয়েছে । যদিও সমাজচেতনার অভাব নেই তবু লক্ষ্যণীয় যে তার রচনায় রাজনৈতিক প্রণোদনা অনুপস্থিত । সকল রচনাতেই একটা প্রগাঢ শুভবোধ ক্রিয়াশীল থাকে ; ফলে ; নেতিবাচক ;

চরিত্রও তার লেখনীতে লাভ করে দরদী রূপায়ণ । এ বিষয়ে তিনি মার্কিন  লেখক  স্টেইনবেক দ্বারা প্রভাবিত । অনেক রচনার মধ্যে তার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং উপলদ্ধির প্রচ্ছাপ লক্ষ্য করা যায় । ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাস মধ্যহ্ন তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা হিসেবে পরি গণিত । এছাড়া জোছনা ও জননীর গল্প আর একটি বড়ো মাপের রচনা , যা - কিনা ১৯৭১ - এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অবলম্বন করে রচিত । তবে সাধারনত তিনি সমসাময়িক ঘটনাবলি লিখে থাকেন ।



পারিবারিক জীবন :– হুমায়ূন আহমেদের প্রথমা স্ত্রীর নাম গুলতেকিন  আহমেদ । তাদের বিবাহ হয় ১৯৮৩ সালে । এই দম্পতির তিন মেয়ে এবং এক ছেলে । তিন মেয়ের নাম বিপাশা আহমেদ , নোভা আহমেদ, শীলা আহমেদ , এবং ছেলের নাম নুহাশ আহমেদ । অন্য আরেকটি ছেলে অকালে মারা যায় । ১৯৯০ সালে মধ্য ভাগ থেকে শিলার বান্ধবী এবং তার বেশ কিছু নাটক চলচ্চিত্রে অভিনয় করা অভিনেত্রী শাওনের সাথে হুমায়ূন আহমেদের ঘনিষ্টতা জন্মে । এরফলে সৃষ্ট পারিবারিক অশান্তির অবসানকল্পে ২০০৫ - এ গুলতেকিনের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হয় এবং ঐ বছরই শাওনকে বিয়ে করেন । এঘরে তাদের তিন ছেলে - মেয়ে জন্ম গ্রহণ করে । প্রথম ভুনিষ্ঠ কন্যাটি মারা যায় । ছেলেদের নাম নিষাদ হুমায়ূন ও নিনিত হুমায়ূন ।


ব্যক্তিগতজীবন :– জীবনের শেষ ভাগে ঢাকা শহরের অভিজাত আবাসিক এলাকা ধানমন্ডির ৩/এ রোড নিমিত দক্ষিণ হওয়া ভবনের একটি ফ্ল্যাটে তিনি বসবাস করছেনন । খুব ভোর বেলা ওঠা তার অভ্যাস ছিল তার , ভোর থেকে সকাল ১০ - ১১ অবধি লিখতেন তিনি । মাটিতে বসে লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন  । কখনো অবসর পেলে ছবির আঁকতেন । জীবনের শেষ এক যুগ ঢাকার অদূরে গাজীপুরের গ্রামাঞ্চলে ৯০ বিঘা জমির ওপর স্থাপিত বাগান বাড়ী ' নুহাশ পল্লীতে ' থাকতে ভালোবাসতেন তিনি । তিনি বিবরবাসি মানুষ , তবে মজশিলী ছিলেন । গল্প বলতে আর রসিকতা করতে খুব পছন্দ করতেন । তিনি ভনিতাবিহিন ছিলেন । নিরবে মানুষের স্বভাব - প্রকৃতি ,আচার, আচরন , পর্যবেক্ষণ করা তার শখ । তবে সাহিত্য পরিমন্ডলের সঙ্গকিন রাজনীতি বা দলাদলিতে কখনো নিজেকে জড়িয়ে ফেলেননি । তিনি কিছুটা লাজুক প্রকৃতির মানুষ এবং বিপুল জনপ্রিয়তা সত্বেও অন্তরাল জীবন যাপনে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন । তবে নিঃসঙ্গতা খুব একটা পছন্দ করতেন না । কোথাও গেলে আত্মীয় - স্বজন , বন্ধু - বান্ধব  নিয়ে যেতে পছন্দ করতেন । বাংলাদেশে তার প্রভাব তীব্র ও গভীর ; এজন্য জাতীয় বিষয়ে ও সংকটে প্রায় তার বক্তব্য সংবাদ সমূহ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করে থাকতো । অতুলনীয় জনপ্রিয়তা সত্বেও তিনি অন্তরাল জীবন যাপন করেন এবং লেখালেখি ও চিত্রনির্মাণের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন ।

চলচ্চিত্র নির্মাণ :– টেলিভিশনের জন্য একের পর এক দর্শক নন্দিত নাটক রচনার পর হুমায়ূন আহমেদ ১৯৯০ - এর গোড়ার দিকে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন । তার পরিচালনায় প্রথম চলচ্চিত্র আগুনের পরশমনি মুক্তি পায় ১৯৯৪ সালে । ২০০০ সালে শ্রাবণ মেঘের দিন ও ২০০১ সালে দুই দুয়ারী চলচ্চিত্র দুটি প্রথম শ্রেণীর দর্শক দের কাছে দারুন গ্রহণযোগ্যতা পায় । ২০০৩ - এ নির্মাণ করেন চন্দ্রকথা নামে একটি চলচ্চিত্র । ১৯৭১- এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পেক্ষাপটে ২০০৪ সালে নির্মাণ করেন শ্যামল ছায়া চলচ্চিত্রটি । অতীত ২০০৬ সালে " সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র" বিভাগে একাডেমী পুরস্কার এর জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল । এছাড়াও চলচ্চিত্রটি কয়েকটি আন্তজার্তিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় । তার সব চলচ্চিত্রে তিনি নিজে গান রচনা করেন। ২০১২ সালে তার পরিচালনার সর্বশেষ ছবি ঘেটুপুত্র কমলা ( চলচ্চিত্র ) । এছাড়াও হুমায়ূন আহমেদের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র । এর মধ্যে ২০০৬ সালে মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত দুরন্ত , বেলাল আহমেদ পরিচালিত নন্দিত নরকে এবং আবু সাইদ পরিচালিত নিরন্তর । ২০০৭ - এ শাহ আলম কিরণ পরিচালিত সাজঘর এবং তৌকির আহমেদ নির্মাণ করেন বহুল আলোচিত চলচ্চিত্র দারুচিনি দ্বীপ ।



কান্সার ও মৃত্যু :– ২০১১ - এর সেপ্টেম্বর মাসে সিঙ্গাপুরে ডাক্তারী চিকিৎসার সময় তার দেহে মলাশয়ের কান্সার ধরা পড়ে ।তিনি নিউইয়কের মেমোরিয়াল স্লয়ান কেটরিং কান্সার সেন্টারে চিকিৎসা গ্রহণ করেন । তবে টিউমার বাইরে ছড়িয়ে না পড়ায় সহজে তার চিকিৎসা প্রাথমিক ভাবে সম্ভব হলেও অল্প সময়ের মাঝেই তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় । ১২ দফায় তাকে কেমোথেরাপি দেওয়া হয়েছিল । অস্ত্রোপচারের পর তাঁর কিছুটা শারীরিক উন্নতি হলেও , শেষ মুহূর্তে শরীরের অজ্ঞাত ভাইরাস আক্রমন করায় তার অবস্থা দ্রুত অবনতির দিকে যায় । কৃত্রিম ভাবে লাইভ সাপোর্টে রাখার পর ১৯ জুলাই ২০১২ তারিখে হুমায়ূন আহমেদ মৃত্যুবরণ করেন । মলাশয়ের কান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ নয় মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর ২০১২ সালের ১৯ জুলাই - এ স্থানীয় সময় ১১:২০ মিনিটে নিউ ইয়র্কের বেলেভু হাসপাতালে এই নন্দিত লেখক মৃত্যুবরণ করেন । তাকে নুহাশ পল্লীতে দাফন করা হয় । তার মৃত্যুতে সারা বাংলাদেশে সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যে অভূটপূর্ব আহাজারির সৃষ্টি হয় । তার মৃত্যুর ফলে  বাংলা সাহিত্যে ও চলচ্চিত্র অঙ্গনে এক শূন্যতার সৃষ্টি হয় ।


                        সমাপ্ত




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন