বাঙালির চিত্রকলা চর্চার ধারায় নন্দলাল বসুর অবস্থান ও তাঁর অবদান সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো ।
উত্তর >>> হুগলি জেলার অন্তর্গত তারকেশ্বরের কাছে জেজুর গ্রামের অধিবাসী নন্দলাল বসু ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের ৩ ফেব্রুয়ারি পিতা পূর্ণচন্দ্র বসুর কর্মস্থল বিহারের মুঙ্গেরে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি প্রথমে দ্বারভাঙ্গায় ও পরে কলকাতার সেন্ট্রাল কলেজিয়েট স্কুলে বিদ্যার্জন করেন । তিনি ছেলেবেলায় কুমোরদের দেখাদেখি মূর্তি গড়তেন । তাঁর পিসতুতো ভাই অতুল মিত্র ছিলেন আর্ট কলেজের ছাত্র । তাঁর পরামর্শে নিজের আঁকা ছবি নিয়ে নন্দলাল আর্ট কলেজে অবনীন্দ্রনাথ ও হ্যাভেল সাহেবের সঙ্গে দেখা করেন ও আর্ট স্কুলে ছাত্র হিসেবে গৃহীত হন । তাঁর আঁকা বিখ্যাত ছবিগুলির মধ্যে রয়েছে – ‘সিদ্ধিদাতা গণেশ’, ‘শোকার্ত সিদ্ধার্থ’, ‘সতী’, ‘শিবসতী’, ‘জগাই-মাধাই’, ‘কৰ্ণ’, ‘গরুড়স্তম্ভতলে শ্রীচৈতন্য’, ‘নটরাজের তাণ্ডব’, ‘ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা’, ‘জতুগৃহদাহ’, ‘অহল্যার শাপমুক্তি’, ‘পার্থসারথি’, ‘শিব মুখমণ্ডল’, ‘শিবের বিষপান’, ‘যম ও নচিকেতা’, ‘মহাপ্রস্থানের পথে যুধিষ্ঠির’, ‘উমার ব্যথা’, ‘উমার তপস্যা’, ‘প্রত্যাবর্তন’ প্রভৃতি । এই ছবিগুলির মধ্যে অধিকাংশই ১৯০৬-১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আঁকা । পৌরাণিক বিষয়কে ভিত্তি করে আঁকা তাঁর এই ছবিগুলির আবেদন আজও অপরিসীম । তাঁর রূপনির্মাণের বিশেষ ভঙ্গি ছবিগুলিতে ধরা পড়েছে ।
>>> ১৯১১-য় আর্ট স্কুলের পাঠ শেষ করে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে জোড়াসাঁকোয় শিল্পচর্চা নন্দলাল বসুর এক অনন্য অভিজ্ঞতা । ভগিনী নিবেদিতার বইয়ের চিত্রসজ্জা রচনা করা ছাড়াও তিনি রবীন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথেরও বহু বইয়ের অলংকরণ করেন । লেডি হেরিংহ্যামের সহকারী হিসেবে তিনি অজন্তা গুহাচিত্রের নকল করার কাজ করেন (১৯০৯) । ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে নন্দলাল স্থায়ীভাবে শান্তিনিকেতনে বাস করতে যান এবং ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে কলাভবনের অধ্যক্ষ হন । তাঁর স্মরণীয় কীর্তির মধ্যে রয়েছে গোয়ালিয়রের বাগ্ গুহার ভিত্তিচিত্রের প্রতিলিপিগ্রহণ , জগদীশচন্দ্রের আহ্বানে ‘'বসু বিজ্ঞানমন্দির’ অলংকরণ , জোড়াসাঁকোর বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত বিচিত্র ক্লাবে শিল্প শিক্ষকতা , মহাত্মা গান্ধির আহ্বানে লখনউ , ফৈজপুর ও হরিপুরা কংগ্রেস অধিবেশন উপলক্ষ্যে ভারতশিল্প প্রদর্শনী সংগঠন , ‘হরিপুরাপট’ অঙ্কন ইত্যাদি । কাশী ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে যথাক্রমে ডক্টরেট ও ডি. লিট উপাধিতে সম্মানিত করেন । ‘শিল্পচর্চা’ ও ‘রূপাবলী’ তাঁর লেখা শিল্পসংক্রান্ত গ্রন্থ । তিনি রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনিকে কালীঘাটের রঙিন পটের মতো করে রূপদান করেন। ভারতীয় সংবিধান তাঁরই আঁকা চিত্রে ও নির্দেশে অলংকৃত হয় । ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে ‘পদ্মবিভূষণ’-এ ভূষিত নন্দলাল বসু ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ এপ্রিল লোকান্তরিত হন ।

No comments