বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে মৃণাল সেনের অবদান সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো ।
উত্তর :- বাংলা সিনেমায় নতুন ধারা বয়ে আনেন মৃণাল সেন (১৪.৫.১৯২৩) । ১৯৫৫ থেকে চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে মৃণাল সেনের যাত্রা শুরু । আজ অবধি সেই ধারা বহমান রয়েছে । টেলিফিল্ম , শর্টফিল্ম , ডকুমেন্টারি ফিল্ম এবং পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি সব মিলিয়ে সংখ্যাটি প্রায় পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে । তাঁর প্রথম ছবি ‘রাতভোর' (১৯৫৫) । ওই একই বছর মুক্তি পেয়েছে ‘পথের পাঁচালী’ । ‘রাতভোর’-এ ব্যর্থ হলেন পরিচালক মৃণাল সেন । কিন্তু সেই ব্যর্থতা তাঁকে দমাতে পারেনি । পরবর্তী ছবি ‘নীল আকাশের নীচে’ সাফল্য পেল । তৃতীয় ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’ । এখান থেকেই তিনি খুঁজে নিলেন নিজের চলার পথ । চলচ্চিত্র শিল্পের প্রতি গভীর অনুরাগ , ভালোবাসা এবং আবেগ না থাকলে এটা অসম্ভব ছিল । চলচ্চিত্র পরিচালনার আগে থেকে মৃণাল সেন চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখালেখি করতেন । ছবি তৈরির ভাবনা তখন থেকেই । তাঁর নিজের কথায় “ব্যক্তিগতভাবে বলতে গেলে প্রত্যেক পরবর্তী ছবিতেই বিষয়বস্তু এবং আঙ্গিকে আমি অপেক্ষাকৃত বেশি নিশ্চিত । যেন আই অ্যাম গ্রোয়িং ইন এভরি ফিল্ম । সে কারণেই পুরোনো ছবি সম্পর্কে আমি বেশ ক্রিটিক্যাল । মাঝে মাঝে মনে হয় যদি পুরো ছবিটাকেই ড্রেস রিহার্সাল মনে করে আবার তুলতে পারতাম ।” সত্যজিৎ রায় যেমন শুরু থেকেই ধ্রুপদি সাহিত্য অবলম্বনে ছবি তৈরি করেছেন , মৃণাল সেন তা করেননি । বরং তাঁর বিপরীত অবস্থানটিই মৃণাল সেনের ছবির বৈশিষ্ট্য ।( সত্যজিৎ রায় সে-কথা স্বীকার করে বলেছেন — “দে স্টার্টেড অ্যাট অ্যাবাউট দ্য সেম টাইম অ্যাজ আই ডিড , ঋত্বিক অ্যান্ড মৃণাল , দে ওয়্যার মেকিং ফিল্ম ভেরি ডিফারেন্ট ফ্রম মাইন , ভেরি ডিফারেন্ট , বাট ভেরি পাওয়ারফুল , আই থিংক ।” মৃণাল সেন পরিচালিত ছবির তালিকা যথাক্রমে— ‘রাতভোর' (১৯৫৫) , ‘নীল আকাশের নীচে’ (১৯৫৮), ‘বাইশে শ্রাবণ’(১৯৬০), ‘পুনশ্চ’ (১৯৬১), ‘অবশেষে’ (১৯৬৩),‘প্রতিনিধি’(১৯৬৪), ‘আকাশ কুসুম’(১৯৬৫), ‘মাটির মানুষ’ (১৯৬৬), ‘ভুবনসোম’ (১৯৬৯), ‘ইন্টারভিউ’ (১৯৭১), ‘এক আধুরি কহানি’ (১৯৭১), ‘কলকাতা ৭১' (১৯৭২), ‘পদাতিক’ (১৯৭৩), ‘কোরাস’ (১৯৭৪), ‘মৃগয়া’ (১৯৭৬), ‘ওকা উরি কথা’ (তেলেগু) (১৯৭৭), ‘পরশুরাম’ (১৯৭৮), ‘একদিন প্রতিদিন’ (১৯৭৯), 'চালচিত্র' (১৯৮১), ‘আকালের সন্ধানে' (১৯৮২), ‘খারিজ' (১৯৮২), ‘খণ্ডহর' (১৯৮৩), ‘জেনেসিস’ (১৯৮৬), ‘একদিন অচানক’ (১৯৮৯), ‘মহাপৃথিবী’ (১৯৯১), ‘অন্তরীণ’ (১৯৯৩), ‘আমার ভুবন' (২০০২) । সারা জীবনে মৃণাল সেন অসংখ্য জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন । বাংলা ছবিকে পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বের দরবারে । তাঁর নির্মিত তথ্যচিত্রগুলির মধ্যে রয়েছে ‘মুভিং পারসপেকটিভস্’ (১৯৬৭), ‘ত্রিপুরা প্রসঙ্গ’ (১৯৮২), ‘ক্যালকাটা মাই এলডোরাডো’ (১৯৮৯), ‘অ্যান্ড দি শো গোজ অন’(১৯৯৬) । এ ছাড়াও তিনি ‘তসবির আপনি আপনি’ (১৯৮৪) নামে একটি দূরদর্শন চিত্র , বহু দূরদর্শন ধারাবাহিকের চিত্রনাট্য রচনা করেন ( যেমন—‘দশ সাল বাদ’, ‘আজনভি’, শাল’, ‘সালগিরা’, ‘জিত’, ‘দো বহেন’, ‘আজকাল’, ‘রবিবার’, ‘আয়না’, ‘স্বয়ম্ভব’, ‘কভি দূর কভি পাস’, ‘অপরাজিত’)। ‘রাজধানী থেকে’ (১৯৫৮), ‘কানামাছি’ (১৯৬১), ‘জোড়াদীঘির চৌধুরী পরিবার' (১৯৬৬) এবং ‘কাচকাটা হীরে’(১৯৬৬)-র চিত্রনাট্যও মৃণাল সেনের রচনা।

No comments