বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তপন সিংহের অবদান সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো ।
উত্তর >>> পাঁচ-এর দশকে যে সমস্ত বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালকের হাতে বাংলা ছবি প্রাণ ফিরে পায় , তাঁদের মধ্যে অন্যতম তপন সিংহ (২.১০.১৯২৪-১৫.০১.২০০৯) । তাঁর আবির্ভাবের পূর্বে বাংলা ছবি চলছিল গতানুগতিক প্রেম ভালোবাসা আর ধর্মনির্ভর বিষয় নিয়ে । সেই একঘেয়েমি থেকে বাঙালি দর্শক মুক্তি পেল , দেখল সিনেমাও হয়ে ওঠে গীতিকবিতার মতন চিত্রধর্মী এবং মানবাবেগে ভরপুর এক শিল্পকলা । তাঁর ছবির দর্শক হয়ে উঠলেন সব রকম মানুষ — সাধারণ আর বিশিষ্ট সকলেই , আর্ট-এর ক্ষেত্রে এবং বক্স অফিসের মেলবন্ধনে তিনি প্রমাণ করলেন আপন অনন্য প্রতিভা । কারণ , তাঁর প্রায় প্রতিটি ছবিই কালজয়ী। প্রত্যেক ছবিতেই তিনি বিষয় বদলেছেন , পটভূমি বদলেছেন । কখনও অন্দরে , কখনও আবার নিসর্গ প্রকৃতির মাঝে । আর আছেন রবীন্দ্রনাথ । তাঁর বহু ছবির কাহিনি রবীন্দ্রনাথের । সমসাময়িক অন্যান্য সাহিত্যিকদের গল্প উপন্যাসও অবলম্বন করেছেন ছবি তৈরির ক্ষেত্রে । বাঙালি দর্শক সম্পর্কে তিনি উচ্ছ্বসিত । তাঁর মতে— “সারা পৃথিবীতে দর্শক হিসেবে বাঙালি দর্শকই শ্রেষ্ঠ । সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা , ছবির প্রতি ভালোবাসা , নাটকের প্রতি ভালোবাসা , আর কোনো দেশের দর্শকের মধ্যে খুঁজে পাবেন কি না সন্দেহ ।”
>>> নিজের ছবি সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য —“বৃহৎ অর্থে আমার দু-চারটি ছবি ছাড়া আর সব ছবিই তো ভালোবাসার । মানুষকে ভালোবাসা , পৃথিবীকে ভালোবাসার কথাই তো আমি বলতে চেয়েছি বরাবর । তবে যদি নারী-পুরুষের প্রেমের কথা বলেন , তা হলে সে ধরনের ছবির সংখ্যা কম ।”
তপন সিংহ পরিচালিত বিখ্যাত বাংলা ছবির তালিকাটি এইরকম —‘অঙ্কুশ’ (১৯৫৪), ‘উপহার’ (১৯৫৫), ‘কাবুলিওয়ালা’ (১৯৫৭), ‘লৌহকপাট’ (১৯৫৮), ‘ক্ষণিকের অতিথি’ (১৯৫৯), ‘ক্ষুধিত পাষাণ’(১৯৬০), ‘ঝিন্দের বন্দি’ (১৯৬১), ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ (১৯৬২), ‘নির্জন সৈকতে’ (১৯৬৩), ‘জতুগৃহ’ (১৯৬৪), ‘আরোহী’ (১৯৬৪), ‘অতিথি’ (১৯৬৫), ‘গল্প হলেও সত্যি’ (১৯৬৬), 'হাটেবাজারে' (১৯৬৭), ‘আপনজন' (১৯৬৮), 'সাগিনা মাহাতো' (১৯৭০), ‘আঁধার পেরিয়ে’(১৯৭৩), ‘হারমোনিয়াম’(১৯৭৬), ‘সবুজদ্বীপের রাজা’ (১৯৭৯), বাঞ্ছারামের বাগান’(১৯৮০), “বৈদুর্য রহস্য' (১৯৮৫), ‘আতঙ্ক’(১৯৮৬), ‘অন্তর্ধান' (১৯৯২), ‘হুইলচেয়ার’(১৯৯৪) ।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন অনেক । তার থেকে বেশি মূল্যবান দর্শকদের ভালোবাসা — তা পেয়েছেন জীবনভর ।

No comments